

writer
LUTFOR RAHMAN RITON
লেখক
লুৎফর রহমান রিটন
ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী--০৬
অন্য ভুবনে আওলাদ> আমার অশ্রুসজল আশীর্বাদ...
লুৎফর রহমান রিটন
মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন। আমাদের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র সাংবাদিক। মানবজমিন পত্রিকার সিনিয়র কালচারাল রিপোর্টার। আমার বিশেষ প্রীতিভাজন। চ্যানেল আই-এর যে কোনো উৎসবে আনন্দ সমাবেশে যাঁর উপস্থিতি ছিলো নিয়মিত। গতরাতে চলে গেছে না ফেরার দেশে। চ্যানেল আই-এর গানে গানে সকাল শুরু অনুষ্ঠানের শুরুতেই আওলাদের মৃত্যু সংবাদ। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আহারে! কতো স্মৃতি এই ছোট ভাইটির সঙ্গে!
কাজ করতাম দৈনিক খবর হাউসে। সাপ্তাহিক মনোরমার দায়িত্বে ছিলাম আমি। ছায়াছন্দের দায়িত্বে ছিলেন হারূনুর রশীদ খান। চিত্রবাংলার দায়িত্বে গোলাম কিবরিয়া। ছায়াছন্দ আর চিত্রবাংলায় লিখতে শুরু করলো আওলাদ। বিনে পয়সার কন্ট্রিবিউটর। টাকা পয়সার দরকার নেই। নিয়মিত ওর নামে রিপোর্ট ছাপা হলেই সে খুশি।
নিয়মিত আমাদের অফিসে আসে। আমাকে দেখলেই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। পুরোন ঢাকার ছেলে। কথাবার্তা আর চালচলনে ঢাকাইয়া ছাপ। আমিও ঢাকাইয়া। আমার সঙ্গে খুবই খাতির জমিয়ে ফেললো ছেলেটা। কোনো এক নায়ক কিংবা নায়িকার সাক্ষাৎকারের এসাইনমেন্ট দিলেন হারূণ ভাই। কী যে খুশি আওলাদ! নতুন প্যান্ট আর শার্ট কিনে ফেললো। সেই নতুন প্যান্ট-শার্ট পরে আমাকে দেখালো। ওর যুক্তি--এতো বিখ্যাত একজন শিল্পীর কাছে যাচ্ছে, পোশাকটা গর্জিয়াস হওয়া চাই। আমিও পিঠ চাপড়াই--গুড। তোমারে দিয়া হইবো। লাইগা থাকো মিয়া!
আওলাদ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বসে--দোয়া কইরেন গুরু!
আওলাদ লেগে থাকে। বিনে পয়সার কন্ট্রিবিউটর আওলাদের চাকরি হয় ছায়াছন্দে। হারূণ ভাইয়ের কর্মী বাহিনির তিন তরুণ তুর্কি--আওলাদ হোসেন-রেজাউর রহমান ইজাজ আর শরীফ দাপিয়ে বেড়ায় এফডিসি এবং রামপুরা টিভি স্টেশন। খুব দ্রুতই আওলাদ ফিল্মের মানুষজনদের প্রিয়ভাজন তরুণ সাংবাদিক হিশেবে নিজের একটা চমৎকার অবস্থান তৈরি করে ফেললো।
দিন যায়।
আমার কাছে খবর আসে--নায়িকা মৌসুমী কিংবা নায়ক মান্নার খুব ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠেছে আমাদের আওলাদ। চলচ্চিত্র জগতের প্রবীনদেরও আস্থাভাজন সাংবাদিক হয়ে উঠলো আমাদের আওলাদ। চলচ্চিত্রের শিল্পী-কলাকুশলী-পরিচালক-প্রযোজক-পরিবেশক সকলেই আওলাদকে ভালোবাসেন। এভাবে ক্রমশঃ ঢাকাই ফিল্মি দুনিয়ায় একটি অপরিহার্য নাম হিশেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললো মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন নামের সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণটি।
ঢাকাই ছবি বিষয়ে আওলাদ ছিলো রীতিমতো তথ্য ভাণ্ডার। ঢাকার সিনেমা কিংবা নায়ক-নায়িকা বিষয়ে আমার কোনো কনফিউশন থাকলে আমি একজনকেই জিজ্ঞেস করতাম, আওলাদ এইটা কবে রিলিজ হয়েছিলো? ওঁর প্রথম সিনেমা কোনটি? হয় টেলিফোনে কিংবা ফেসবুকে ওর ইনবক্সে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিতাম। অসম্ভব ক্ষিপ্র গতিতে জবাব চলে আসতো। এই কারণে আমি ওকে বলতাম ঢাকাই ছবির এনসাইক্লোপিডিয়া। শুনে আওলাদ খুশিও হতো আবার লজ্জাও পেতো। বলতো-গুরু দোয়া কইরেন!
আমার সম্পাদনায় 'ইমপ্রেস টেলিফিল্ম চলচ্চিত্র য়্যালবাম' প্রকাশিত হয়েছিলো ২০১১ সালে। ঢাউস সাইজের ওই য়্যালবামে আওলাদের তথ্য সহায়তা আমাদের অনেক সমৃদ্ধ করেছিলো। আওলাদ ওর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যগুণে সাগর ভাই অর্থাৎ ফরিদুর রেজা সাগরেরও মনোযোগ আর ভালোবাসা কেড়েছিলো বিপুল পরিমাণে। 'ছোটকাকু' ছাড়াও ছোটদের জন্যে রচিত সাগর ভাইয়ের একটা সিরিজ বই আছে। ওই সিরিজের বইগুলোর চরিত্ররা কাল্পনিক থাকে না। ওরা বাস্তবের পরিচিত মুখ। অভিনব সেই ছোটদের বইয়ের চরিত্র হিশেবে কখনো শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কখনো জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, কিংবা কখনো নায়করাজ রাজ্জাককে খুদে পাঠকদের সামনে হাজির করেন সাগর ভাই। এই সিরিজের আরেকটা বৈশিষ্ট্য--বইগুলোয় কোনো ইলাস্ট্রেশন থাকে না। থাকে আলোকচিত্র। গল্প অনুযায়ী সিকোয়েন্স মিলিয়ে আলোকচিত্র। মনে আছে, সাগর ভাই একটা বইতে সাংবাদিকের চরিত্রে মোহাম্মদ আওলাদ হোসেনকে চিত্রিত করেছিলেন। বইটিতে আওলাদের অনেকগুলো চাররঙা আলোকচিত্র ছিলো!
বইটি হাতে পেয়ে মহাউচ্ছ্বসিত আমি বলেছিলাম--তুমি তো মিয়া অমরত্ম পাইয়া গেলা! জবাবে হাস্যোজ্জ্বল আওলাদ বলেছিলো--আপনার আশীর্বাদ গুরু!
২০০১ এর মধ্য জুন থেকে আমি দেশান্তরী হয়ে টানা সাত বছর কানাডায় কাটিয়ে দেশে ফিরে ২০০৮ এর বইমেলায় আওলাদের সঙ্গে দেখা। আওলাদ আমার একটা ইন্টারভিউ করতে চাইলো মানবজমিন পত্রিকার জন্যে। বাংলা একাডেমিতে এক সন্ধ্যায় কোনো একটা স্টলে বসে আওলাদ আমাকে নানা প্রশ্ন করলো। আমি জবাব দিলাম। এক পর্যায়ে ইন্টারভিউ নেয়া শেষ হলো। আওলাদের সঙ্গে কোনো রেকর্ডার ছিলো না। ছিলো না কোনো নোটবুক। আওলাদ আমাকে প্রশ্ন করছিলো, আমার জবাবগুলো শুনছিলো, এবং আবারো প্রশ্ন করছিলো। কিন্তু কোনো নোট নিচ্ছিলো না। এক পর্যায়ে আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে আওলাদ চলে যাচ্ছিলো। আমি বললাম--কী দেখাইলা এইটা? রেকর্ড করলা না, নোটও নিলা না, কাহিনি কী?
আওলাদ বলেছিলো--এতোদিন আপনাগো কাছ থিকা কী শিখলাম গুরু? নোট লাগবো না। আমার উপ্রে আস্থা রাখেন। কোনো উলটাপালটা হইবো না।
মানবজমিন পত্রিকায় কয়েকদিন পরে আমার সাক্ষাৎকারটি ছাপা হলো। আমি বিস্মিত হলাম! কোনো ভুল নেই। সবকিছু একদম ঠিকঠাক! আমি যা যা বলেছি একদম হবহু সেই কথাগুলোই লিখেছে আওলাদ!
ফেসবুকে আওলাদ স্ট্যাটাস দিতো নিয়মিত। ওর স্ট্যাটাসের শতকরা ৯৯ভাগই ছিলো কোনো না কোনো গানের পঙ্ক্তি। ফেসবুকে আমার লেখাগুলোয় ছোট ছোট মন্তব্যে আওলাদ তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতো। আমার পোস্ট করা লেখায় আর কোনোদিন কমেন্ট করবে না আওলাদ!
কানাডা থেকে মাঝে মধ্যেই কোনো উপলক্ষ্য ছাড়াই আওলাদকে আমি ফোন করতাম। মধ্যরাতে ফোন করতাম। ফোন করতাম খুব সকাল বেলাতেও। এরমধ্যে একদিন ওর বউ আর ছেলেমেয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই আওলাদ বলেছিলো--বউ আর ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে খুব ভালো আছি গুরু। ছেলেটা মেডিকেলে পড়ছে। মেয়েটাও ডাক্তারি পড়বে। আপনার কথামতো 'সংসার' বানানটা ঠিক রেখেছি গুরু।
আওলাদের কথায় সেদিন আমার মনে পড়েছিলো অনেক বছর আগের এক সন্ধ্যার স্মৃতি। আওলাদের বিয়ের রিসেপশন ছিলো সেই সন্ধ্যায়, বেইলি রোডের একটি চিনে রেস্তোরাঁয়। সেই সন্ধ্যায় সাগর পাবলিশার্স থেকে বাংলা বানান বিষয়ক একটা অভিধান কিনে ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম। ইনার পেজে লিখে দিয়েছিলাম--'প্রিয় আওলাদ, সংসার বানানটা ঠিক রেখো।'
গতকাল রাতে অনুজ প্রতীম সাংবাদিক বন্ধুটি ওর সাজানো সংসারটিকে তছনছ করে দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্য ভুবনে।
প্রিয় আওলাদ, তোমার জন্যে আমার অশ্রুসজল আশীর্বাদ এখনো বহাল রয়েছে! বহাল রয়েছে শর্তহীন ভালোবাসাও। মিউজিক আর রিদমসমৃদ্ধ উজ্জ্বল উচ্ছ্বল রঙঝলমলে চলচ্চিত্রাঙ্গনের মতোই রঙিন আর বর্ণাঢ্য আলোর প্লাবনে সদা ঝলমলে থাকুক তোমার অন্য ভুবনটিও। ভালো থেকো বন্ধু।
অটোয়া ০২ অক্টোবর ২০১৫
ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী--০৪
আহা মিষ্টি কী যে মিষ্টি
লুৎফর রহমান রিটন
সাবিনা ইয়াসমিনের বিখ্যাত একটা জিঙ্গেল ছিলো--আহা মিষ্টি কী যে মিষ্টি এই সুন্দর ছোট সংসার...। সিনেমা হলের জন্যে নির্মিত জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল 'মায়া বড়ি'র ওপর শাদা কালো একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে জিঙ্গেলটি ব্যবহার করা হতো। রোজিনা (পরবর্তীতে নায়িকা) অভিনয় করেছিলেন তাতে। পুরুষ অভিনেতাটি অপরিচিত। রেডিওতেও দিনমান বেজে চলতো জিঙ্গেলটি।এই জিঙ্গেলের সুরটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। সাবিনা ইয়াসমিনের অপরূপ কণ্ঠমাধুর্যের কারণে আমার কাছে জিঙ্গেলটি প্রায় গানের মর্যাদাই পেয়ে গিয়েছিলো। মনের অজান্তেই গুণগুণ করে উঠতাম। তারপর আবিস্কার করতাম আশপাশের মুরুব্বি টাইপের লোকজনের বেদনাহত বিস্ময়দৃষ্টি! অভিভাবকদের কাছে গানটি গোপন বিষয়ের একটি প্রকাশ্য উপস্থাপনজনিত অস্বস্থির ব্যাপার ছিলো। মাঝে মধ্যে তাই ইচ্ছে করেই বাড়তি মজা পাবার আশায় গুণগুণ না করে উচ্চ কণ্ঠেই গেয়ে উঠতাম--আহা মিষ্টি কী যে মিষ্টি এই সুন্দর ছোট সংসার....মায়া আছে এ জীবনে আপন হয়ে/মায়া বড়ি খেতে পারি নির্ভয়ে/এই মায়া বড়ি খেলে রবে সাস্থ্য ভালো সবার.../কেটে যাবে এ জীবন হেসে খেলে/ সন্তান বেশি হবে না আর মায়া খেলে......।
গানের একটা অসাধারণ শক্তি হচ্ছে--প্রতিটি গানেরই কথা আর সুরের সম্মিলনে কিছু ইমেজ তৈরি হয়। সেই ইমেজ আবার একেকজনের কাছে একেকটি পরিবর্তিত রূপে আবির্ভূত হয়। গানে বর্ণিত আনন্দ বা বেদনা বা বিষাদের আবহটা ঠিক একই রকম থাকলেও পাত্রপাত্রী কিংবা পারিপার্শ্বিক আবহটা পরিবর্তিত হয়ে শ্রোতার নিজের পছন্দের ইমেজটি সেখানে মূর্ত হয়ে ওঠে। মজার ব্যাপার হচ্ছে--মেয়েদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের 'মায়া বড়ি'র জিঙ্গেলটি শুনবার সময় কিংবা গাইবার সময় আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে কোনো ট্যাবলেট ক্যাপসুল বা নারীর ইমেজ অনুরণন তুলতো না। অনুরণন তুলতো--রসগোল্লা-চমচম-লালমোহন-কালোজাম-বুন্দিয়া ইত্যাদি নামের প্রিয় মিষ্টিগুলোর দুর্ধর্ষ অবয়ব!
ইন্টারনেটে ইধার-উধার ব্রাউজ করতে করতে আজ ধ্বংসাত্মক এই ছবিটা দেখে বুকের ভেতরটা কী রকম হাহাকার করে উঠলো! আশপাশে কে আছে না আছে তার তোয়াক্কা না করে বহুদিন পর আপন মনেই গেয়ে উঠলাম সত্তরের দশকের বিখ্যাত সেই জিঙ্গেলটা--আহা মিষ্টি কী যে মিষ্টি এই সুন্দর ছোট সংসার...।
(আহা রে কতোদিন পাই না তোদের, কতোদিন খাই না তোদের...)
অটোয়া ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী--০৩
ইমদাদুল হক মিলন > তারুণ্য স্পর্ধিত স্মার্ট লেখকের প্রতিচ্ছবি
লুৎফর রহমান রিটন
লেখক ইমদাদুল হক মিলনের যাত্রা শুরু শিশুসাহিত্যের হাত ধরে। 'বন্ধু' নামের একটি ছোটদের উপযোগী গল্প দিয়েই আজকের মহাবিখ্যাত কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের দীর্ঘ অভিযাত্রার সূচনা ঘটেছিলো। তাঁর হাতে ছিলো একটি সোনার কলম। সেই সোনার কলম দিয়ে এরপর অবিরাম লিখে গেছেন মিলন। চেহারা পোশাক আর চালচলনের মতোই তাঁর স্মার্ট গদ্যভঙ্গিটি শিগগিরই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তরুণ বয়েসে সেই যে জনপ্রিয় হয়েছেন, আজও সেই জনপ্রিয়তাকে ধরে রেখেছেন তিনি। তাঁর বেশিরভাগ লেখাই বড়দের উপযোগী। কিন্তু শিশুসাহিত্য দিয়ে যাঁর লেখালেখির সূচনা, ছোটদের তিনি উপেক্ষা করবেন কী ভাবে! না, ছোটদের তিনি মোটেও উপেক্ষা করেননি। ছোটদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি একের পর এক বই লিখেছেন তাদের জন্যে। সেই তালিকাটা মোটেও ছোট নয়। চিতারহস্য, রাত বারোটা, ভূতের নাম রমাকান্ত কামার, ভূতগুলো খুব দুষ্টু ছিলো, ভূতের নাম হাবা গঙ্গারাম কিংবা ডাকাতরাও মানুষ—এরকম বেশ কিছু বইয়ের নাম স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারি। 'ডাকাতরাও মানুষ' উপন্যাসটি আমার সম্পাদিত 'ছোটদের কাগজ'-এ ছাপা হয়েছিলো ১৯৯৭ সালে।
ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে আমার অনেক মিল খুঁজে পাই আমি। প্রায় একই সময়ে লেখালেখির শুরু আমাদের। আমার প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিলো ১৯৭২ সালে, দৈনিক ইত্তেফাকের ছোটদের পাতা কচি-কাঁচার আসরে। ছেপেছিলেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। ইমদাদুল হক মিলনের প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিলো ১৯৭৩ সালে, দৈনিক পূর্বেদেশের ছোটদের পাতা চাঁদের হাটে। ছেপেছিলেন রফিকুল হক দাদুভাই। আমাদের নামের ব্যাপারেও মিল রয়েছে। আমরা দু'জনেই নামের সঙ্গে ডাকনাম ব্যবহার করি।
২
মূল নামের সঙ্গে ডাক নাম বা নিক নেম থাকলে আফলাতুন ভাই সেই লেখকের কোনো লেখা ছাপতেন না। দৈনিক বাংলা পত্রিকাটির ছোটদের পাতা 'সাতভাই চম্পা'র সম্পাদক ছিলেন আফলাতুন নামের এক সাংবাদিক সাহিত্যিক। সত্তরের দশকে 'সাতভাই চম্পা' এবং আফলাতুনের সঙ্গে আমার বিপুল সখ্য গড়ে ওঠে। আফলাতুন ভাই আমার একটি ছড়া তাঁর সম্পাদিত পাতায় ছাপলেন শুধু লুৎফর রহমান নামে। নামের রিটন অংশটাকে বলপেনের লাল কালিতে ঘ্যাচাং করে দিলেন পরম তৃপ্তি আর চরম নিষ্ঠুরতায়। ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসর, এবং সংবাদের খেলাঘরসহ দেশের বিভিন্ন দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিক পত্রিকায় তখন আমি ধুমসে লিখে যাচ্ছি। আর কোনো সম্পাদক আপত্তি করেন নি রিটন নিয়ে। একমাত্র সম্পাদক আফলাতুন--যিনি লেখকের নামের সঙ্গে ডাক নাম ছাপবেন না বলে কঠিন এবং অবাস্তব একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকলেন তাঁর দফতরে। নামের সঙ্গে ডাকনামটি যুক্ত আছে বলে তখনকার উঠতি তরুণ লেখক ইমদাদুল হক মিলনের কোনো লেখাও তিনি ছাপতেন না। আফলাতুন ভাইয়ের নিষ্ঠুরতার বলি 'রিটন'কে অতঃপর আমি পুনর্জন্ম দিয়েছিলাম 'রিটন রহমান' নামে। এই নামে আমার প্রচুর লেখা ছাপা হয়েছিলো তখন দৈনিক বাংলার সাতভাই চম্পায়।
আমি যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়টায় ছোটদের সেরা পাতা ছিলো সাতভাই চম্পা। মেক আপ গেট আপের দিক থেকে ওই পাতার ধারে কাছেও ছিলো না আর কোনো পাতা। ব্রডশিটের দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হতো সাত ভাই চম্পা। শাদাকালোয় ওরকম ঝকমকে আধুনিক রুচিস্নিগ্ধ পাতা আর দ্বিতীয়টি ছিলো না। রিটন রহমান নামে আবির্ভূত হবার আগে আফলাতুন ভাইয়ের সঙ্গে প্রচুর তর্ক করেছি। আমাদের কথা কাটাকাটি বা ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি তখনকার তরুণ কিন্তু খ্যাতি অর্জন করা লেখক ইমদাদুল হক মিলনের প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম। আফলাতুন ভাই বীরদর্পে বলেছিলেন--'যতদিন পর্যন্ত সে তার ডাকনামটি ছেঁটে না ফেলবে ততদিন আমি তার লেখা ছাপব না। ডাক নাম ব্যবহার করে গাড়লরা।'
এই ঘটনার অনেক বছর পর ঢাকা প্রেসক্লাবে চায়ের টেবিলে মুখোমুখি বসে আমি আর আফলাতুন ভাই গল্প করছিলাম। সাতভাই চম্পার তখন করুণ অবস্থা। দৈনিক বাংলা কর্তৃপক্ষ দুই পৃষ্ঠা থেকে এক পৃষ্ঠা এবং এক পৃষ্ঠা থেকে অর্ধ পৃষ্ঠা জায়গা বরাদ্দ দিচ্ছে তখন সাতভাই চম্পাকে। যে কোনো দিন বন্ধ হয়ে যাবে এককালে ছোটদের বিখ্যাত পাতাটি। আফলাতুন ভাই দুঃখ করে সেই কাহিনিই বলছিলেন আমাকে।
খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আফলাতুন ভাইকে আমি বলেছিলাম--আপনার দীর্ঘ জীবনে সম্পাদক হিশেবে আপনার ব্যর্থতা কি জানেন আফলাতুন ভাই?
--কী?
--আপনি আপনার সম্পাদকজীবনে দু'জন পাঠকপ্রিয় লেখকের একটি লেখাও ছাপেননি বা ছাপাতে পারেননি।
--কোন দু'জনের কথা বলছো?
--ইমদাদুল হক মিলন আর লুৎফর রহমান রিটন।
--কী বলছো এসব? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মিলনের কোনো লেখা আমি ছাপিনি সত্যি কিন্তু তোমার তো অসংখ্য লেখা ছেপেছি আমি সাতভাই চম্পায়, প্রায় প্রতি সপ্তাহে!
--হ্যাঁ আপনি রিটন রহমানের লেখা ছেপেছেন নিয়মিত কিন্তু লুৎফর রহমান রিটনের একটিও নয়।
--কী আবোল তাবোল বকছো? তুমি কি রিটন রহমান নও!
--না। আমি রিটন রহমান নই। আমি লুৎফর রহমান রিটন। সতেরটি বই বেরিয়েছে (তখনকার হিশেব অনুযায়ী) লুৎফর রহমান রিটনের, অথচ সমসাময়িককালের একজন তুখোড় সম্পাদক হওয়া সত্বেও লুৎফর রহমান রিটনের একটি লেখাও আপনি ছাপেননি ডাক নামের কারণে।
--হ্যাঁ, ডাক নামের কারণে। ডাক নাম আমি ছাপি না।
--তাতে সেই লেখকের কিছুই আসে যায় না। আপনি আমার লেখা ছাপেননি। আপনি মিলনের লেখাও ছাপেননি। অথচ চল্লিশটা বই বেরিয়ে গেছে তাঁর। মিলন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। এবং মিলন প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন নামেই। আপনি আপনার জীবদ্দশাতেই দেখতে পাচ্ছেন ডাকনামটা সঙ্গে রেখেই মিলন-রিটনরা মর্যাদা পাচ্ছে। লেখক হিশেবে মিলনের সমান প্রতিষ্ঠা আপনি পাননি, এমনকি আপনার নামটি খুবই ব্যতিক্রমী 'আফলাতুন' হওয়া সত্বেও।
আমার কথার কোনো জবাব দিতে পারেননি আফলাতুন ভাই। বিপন্ন ও বিষণ্ণ মানুষটাকে দেখে সেদিন আমার খুবই মায়া হচ্ছিলো। ভেতরে ভেতরে খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম আমিও, অনেকগুলো অপ্রিয় ও কড়া কথা তাঁকে শুনিয়ে ফেলেছি বলে। কারণ আমার লেখালেখির জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হিশেবে আমি মূল্যায়ন করি এই প্রাজ্ঞ এবং ধীমান ব্যক্তিত্ব আফলাতুনকেই।
বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে অবশেষে আফলাতুন ভাই খুবই বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেছিলেন--মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক। তোমার যুক্তিটা মেনে নিলাম। মিলনকে তো এই মুহূর্তে পাচ্ছি না আমি। তুমি বরং এক কাজ করো। আগামীকাল দুপুরের মধ্যে একটা ছড়া নিয়ে আসো তো দৈনিক বাংলায়। পাতাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটাই শেষ সংখ্যা কী না জানি না। অন্তত একটা লেখা ছাপা হোক তোমার, আমার সম্পাদিত পাতায়, এবং তোমার নিজের নামে।
হ্যাঁ, দু'দিন পরেই সাতভাই চম্পায় ছাপা হয়েছিলো আমার ছড়াটি। এবং সেটা লুৎফর রহমান রিটন নামেই। সম্ভবতঃ সাতভাই চম্পার ওটাই ছিলো আফলাতুনের সম্পাদনায় প্রকাশিত সর্বশেষ সংখ্যা। ডাকনামসহ ইমদাদুল হক মিলনের একটি লেখাও ছাপতে আগ্রহী ছিলেন আফলাতুন ভাই। এই ঘটনাটি ইমদাদুল হক মিলনকে বলা হয়নি। বলা উচিৎ ছিলো আমার। বললে আফলাতুন ভাইয়ের ব্যাপারে মিলনের অভিমান বা ক্ষোভটুকুর হয়তো অবসান ঘটতো। আমি জানি আফলাতুন ভাইয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ বা ক্ষোভ ছিলো ইমদাদুল হক মিলনের। একটি রচনায় তিনি আফলাতুন ভাইয়ের নাম নিয়ে কঠিন বিদ্রুপ করেছিলেন পুরনো ঢাকার বিখ্যাত মিষ্টি 'আফলাতুন'-এর সঙ্গে মিলিয়ে--একটা হালুয়া টাইপের মিষ্টির নামে একজন মানুষের নাম হয় কী করে!
৩
আমার সঙ্গে ইমদাদুল হক মিলনের বয়েসের ব্যবধান পাঁচ/ছয় বছরের। এই অল্প পার্থক্য সত্বেও মিলন আমার মহা অগ্রজের আসনে অধিষ্ঠিত। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাঁকে আমি আপনি সম্বোধন করি। তিনি আমাকে সম্বোধন করেন তুমি। এই তুমি আপনির ব্যাপারটি আসলে খুবই খুচরো। কারণ আমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসি। শ্রদ্ধা করি পরস্পরের মেধাকে। লেখালেখির মাধ্যমটি ভিন্ন হলেও আমাদের দু'জনের মিল রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। মিল সম্ভবত আমাদের চেহারাতেও। মিল আমাদের পোশাক আশাকে। চাল চলনেও। আমাদের চেহারাসুরৎ মোটেও লেখকসুলভ নয়। কেমন গুণ্ডা গুণ্ডা লাগে।
অনেক বছর আগে, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা চারটি ঝলমলে তরুণী একবার বাংলা একাডেমীর বইমেলায় উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আমাকে বলেছিলো--'আপনি আমাদের ভীষণ প্রিয়। আপনার 'দুঃখ-কষ্ট' আমাদের খুব ভালো লেগেছে। অটোগ্রাফ প্লিজ।' ওই চারজন আমাকে মিলন ঠাউরেছে বুঝতে পেরেও নিরুত্তর আমি হাসিমুখে অটোগ্রাফ দিয়েছি ওদের ডায়রিতে। স্বাক্ষরের জায়গায় ইমদাদুল হক মিলনের নামটি না লিখে যখন লুৎফর রহমান রিটন লেখা হলো তখন লজ্জা মেশানো হাসিতে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলো ওরা--'য়ে মা, আপনাদের দু'জনার চেহারায় এত্তো মিল!'
একবার দু'বার এমনটি ঘটেছিলো মিলনের বেলাতেও। মিলনই আমাকে বলেছিলেন—এক সন্ধ্যায় রোকেয়া হলের কিংবা শামসুন্নাহার হলের মিলনায়তনে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মিলনকে ঢুকতে দেখে উপস্থাপক মেয়েটা নাকি ঘোষণা করেছিলো আমার নামটি!
এরপর দিন গড়িয়েছে।
মিলনের কপাল সম্প্রসারিত হয়েছে। মাথায় মৃদু টাকের আবির্ভাব ঘটেছে। তাছাড়া তাঁর ঠোঁট থেকে গুম্ফজোড়া উধাও হওয়াতেও বেঁচে গেছি আমি। এক পর্যায়ে আমার লম্বা চুলও খাটো হয়েছে। মাথায় টাকের আগমনীবার্তা অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।(কিন্তু আমার হালুম মার্কা গুম্ফজোড়া টিকে আছে!) আমাদের দু'জনার চেহারার সাদৃশ্য বা সামঞ্জস্য আর নেই। কেউ আর আমাকে মিলন ভেবে আমার কাছে অটোগ্রাফ চাইতে আসে না এখন!
৪
এই লেখাতেই বলেছি আমরা পস্পপর পরস্পরকে ভালোবাসি। একটা নমুনা দিই।
'টেলিভিশন' নামের একটা মাসিক পত্রিকা ছিলো। ১৯৯৩-এর সেপ্টেম্বরে ওরা একটি অভিনব নিলামের আয়োজন করেছিলো। নিলামের আইটেম হিশেবে ওরা হাজির করেছিলো 'তারকাদের ব্যবহার করা বস্তু-সামগ্রী'। তারকাদের মধ্যে অভিনয়শিল্পী ও নাট্যকাররাও ছিলেন। শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত চত্বরের সেই অনুষ্ঠানে শেষ বিকেলে হাজির হয়েছি যখন তখন নিলামে তোলা হয়েছে লেখক-টিভি নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলনের একটি কলমকে। ঘোষক জানাচ্ছিলেন—এই কলম দিয়েই মিলন লিখেছেন তাঁর পাঠকপ্রিয় উপন্যাস 'ভালোবাসার সুখদুঃখ'। দেখলাম খুবই অল্প দামে উদ্যোক্তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন ইমদাদুল হক মিলনের কলমটি। এতো অল্প দাম যে সেটা রীতিমতো অসম্মানজনক। দামটা উল্লেখ করে ঘোষক 'এক লক্ষ এক, এক লক্ষ দুই, এক লক্ষ তিন টাইপের একটা অতিক্ষুদ্র সংখ্যা ঘোষণা করছিলেন। তিনি তিন উচ্চারণ করার আগে কেউ দাম না বাড়ালে বস্তুটি সেই ক্রেতার মালিকানায় চলে যাবে। ঘোষক দুই গোণার পরেই সহসা ভিড়ের মধ্য থেকে হাত তুলে আমি কলমটির দাম খানিকটা চড়িয়ে দিলাম। যে ভদ্রলোক কলমটির মালিক হতে যাচ্ছিলেন তিনি খানিকটা হতভম্ব। কারণ লেখক বা নাট্যকারের কলম কিনতে আগ্রহী লোকের সংখ্যা অতি নগন্যই ছিলো সেই নিলাম অনুষ্ঠানে। আমার দাম বাড়ানোর কারণে সেই ভদ্রলোক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও সেটা সামলে নিয়ে তিনি আরো দশ টাকা বাড়ালেন। আমি বাড়ালাম পঞ্চাশ টাকা। তিনি আরো দশ বাড়ালেন। আমি বাড়ালাম একশো টাকা। আমার মাথায় কী যে চাপলো তখন! আমি ওখানে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম--এরপরও কেউ যদি আর দশ টাকা বাড়ায় তো আমি বাড়াবো পাঁচশো। এবং এভাবে বাড়াতেই থাকবো। এক পর্যায়ে উৎসাহী জনতাকে(!) পরাজিত করে আমিই বিজয়ী হলাম। ঘোষক মহা আনন্দে আমার বলা দামটি তিনবার উচ্চারণ করলেন। সে কী বিপুল করতালি উপস্থিত দর্শকদের!
সেই অনুষ্ঠানটির বিশেষ বিশেষ অংশ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিক শামীম আলম দীপেন। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো--কেনো আমি মিলনের কলমটি অপেক্ষাকৃত বেশি দামে কিনে নিয়েছি। আমি তখন বলেছিলাম--ইমদাদুল হক মিলনের মতো একজন লেখকের কলমের দাম এতো কম কম হবে কেনো? এটা তো সেই লেখকের প্রতি রীতিমতো অসম্মান। আমি লেখক ইকদাদুল হক মিলনকে সম্মান জানাতেই কলমটি সামান্য বেশি দামে কিনে নিয়েছি। যদিও এই কলম দিয়ে আমি লিখবো না কিছুই। এটা লেখক মিলন ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা।
দীপেনকে সাক্ষাৎকার দেবার পরে সেই ভদ্রলোককে অনেক খুঁজেছি আমি। আমার ইচ্ছে ছিলো কলমটি আমি তাঁকে উপহার দেবো। টাকার অংকে তিনি আমার সঙ্গে সেই সময়টায় পেরে ওঠেননি কিন্তু তিনিও যে মিলনকে ভালোবাসেন সেটা তো প্রমাণিত কারণ তিনি ছাড়া আর কেউ তো কোনো দাম হাঁকায়নি! কিন্তু সেই ভদ্রলোককে পাইনি বলে মিলনের কলমটি তাঁকে উপহার দেয়া হলো না।
আসাদুজ্জামান রিপন সম্পাদিত সেই টেলিভিশন পত্রিকাটির অক্টোবর সংখ্যায় পাঠকের চিঠি বিভাগে একটি চিঠি ছাপা হয়েছিলো। অনুজপ্রতীম এক চলচ্চিত্র সাংবাদিক সেই সংখ্যাটা আমার জন্যে নিয়ে এসেছিলেন। 'মিলনের কলম' শিরোনামে চিঠিটা ছিলো এমন--'টেলিভিশন পত্রিকাকে ধন্যবাদ যে, তারা তারকাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদির অভিনব একটি নিলামের আয়োজন করেছেন। আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে সারাদিন ধরে নিলামস্থলে ঘুরে বেরিয়েছি। আমার প্রিয় অনেক তারকাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। টেলিভিশন পত্রিকা এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য চিরকালই আমার প্রিয় পত্রিকা হয়ে থাকবে। তবে একটা ব্যাপারে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি তা হলো ইমদাদুল হক মিলনের কলম। গত ফেব্রুয়ারির বইমেলায় বেরিয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস 'ভালোবাসার সুখ দুঃখ'। উপন্যাসটি ইতোমধ্যেই তৈরি করেছে জনপ্রিয়তার এক নতুন রেকর্ড। যে কলমটি দিয়ে তিনি এই উপন্যাস লিখেছিলেন সেই কলমটিই নিলামে তুলেছিল টেলিভিশন পত্রিকা। কলমটি আমি কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমার চেয়ে অনেক বেশি দাম তুলে ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন তা কিনে নিয়েছেন। আমার পকেটে খুব বেশি টাকা ছিল না। থাকলে রিটন সাহেবের দ্বিগুণ দাম দিয়ে আমি ওই কলমটি কিনে নিতাম...নাজমুল আলম, মিরপুর ঢাকা।'
৫
ইমদাদুল হক মিলনও যে আমাকে ভালোবাসেন তার একটা নমুনাও দেয়া যাক এবার।
'আমাদের ময়না পাখিগুলো' নামে মিলনের একটি বই বেরিয়েছিলো ২০১০ সালে, সময় প্রকাশন থেকে। বইমেলায় সময়ের স্টল থেকে এক কপি বই তুলে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন মিলন ভাই। বলেছিলেন--উৎসর্গের পাতাটা দেখো। আমি দেখলাম উৎসর্গপত্রে মিলন লিখেছেন--'লুৎফর রহমান রিটন বাংলা ছড়াসাহিত্যের মহারাজ।'
আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই পাতায় তাঁর একটি অটোগ্রাফ নিয়ে নিলাম। এবং সেই কারণে বইটা অমূল্য হয়ে গেলো মুহূর্তেই! অতঃপর বইটা আমার সঙ্গে কানাডাও চলে এসেছে।
এই লেখাটি লিখতে লিখতে বুক সেলফ্ থেকে 'আমাদের ময়না পাখিগুলো'কে লেখার টেবিলে নিয়ে এলাম।
স্মৃতির এলবামে মিলন ভাইয়ের কতো কতো ছবি যে দীপ্তি ছড়াচ্ছে!
অটোয়া ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ক্যাপশন/ ১ ১৯৯৪ সালে আমাদের আজিমপুরের বাসায় নদীর জন্মদিনের ঘরোয়া আনন্দ আয়োজনে ইমদাদুল হক মিলন, আমীরুল ইসলাম, ধ্রুব এষ, ও গোলাম মোর্তোজা। ২/ ১৯৯৩ সালে টেলিভিশন পত্রিকার পাঠকের পাতায় প্রকাশিত সেই চিঠি। ৩/ 'আমাদের ময়না পাখিগুলো'র উৎসর্গপত্রে মিলনের অটোগ্রাফ
ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী--০২
এক অপরাজিতার গল্প
লুৎফর রহমান রিটন
আমি তখন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করি। ১৯৯২ সাল। পদবী ফিচার এডিটর। ছোটদের পাতা 'হইচই' চালাই। প্রবীনদের পাতা 'অমল ধবল' চালাই। এবং বিনে পয়সায় বাড়তি দায়িত্ব হিশেবে চারপাতার 'সাময়িকী'র দেখাশোনা করি। অফিস আমাদের গ্রিন রোডে। নিচ তলায় নিউজ রুমেই আমার বসার জায়গা। সারাদিন আমার দখলে থাকা ফিচার এডিটরের চেয়ার টেবিলে রাতের শিফটে অন্য কেউ বসেন। আমাদের অফিসটা একটা পুরনো দিনের বিল্ডিং ভাড়া নিয়ে সাজিয়েছেন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। পুরনো দিনের বিল্ডিং বলে এর দরোজা জানালাগুলোর সাইজও বিশাল বিশাল। মূল ফটক পেরিয়ে নিউজ রুম বরাবর পাশাপাশি দুটো বিশাল জানালায় সাংবাদিক এবং অতিথিদের আনাগোনা দেখা যায় সরাসরি। এক বিকেলে সেই জানালায় পঞ্চাশ পেরুনো ষাটের কাছাকাছি এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালেন, তারপর একটু উচ্চ কণ্ঠেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন--রিটন না আপনি?
ঘাড় বাঁকিয়ে হাস্যোজ্জ্বল খালার বয়েসী সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম--জ্বি রিটনই তো!
--একটু আসি?
ভদ্রমহিলা অনুমতি চাইলেন।
--আরে আসুন আসুন।
তিনি এলেন। আমার টেবিলের সামনে একটা চেয়ার আগেই পাতা ছিলো, সেটায় বসলেন। তাঁর সঙ্গে একটা মোটামুটি সাইজের ব্যাগ। ব্যাগটা ভেতরে কী আছে বোঝা না গেলেও পরিস্থিতি একেবারে ঠাঁসাঠাঁসি। ফুলত ব্যাগটার একেবারে ফুটুম ফাটুম অবস্থা!
--চা খান আপা? সিঙ্গারা বলি?
--হ্যাঁ চা খাবো। সিঙ্গারাও চলবে।
আমাদের পিওন ছেলেটাকে ইশারা করলাম--চা আর সিঙ্গারা...
অফিসের গেইটের খুব কাছেই চা আর সিঙ্গারার দোকান। খুব তাড়াতাড়িই চলে এলো দুকাপ চা আর একটা পিরিচে গর্মাগরম চারটে সিঙ্গারা। সাধারণত বিকেলে তেমন কেউ থাকে না অফিসে, বিশেষ করে নিউজ রুমে। এই রুমটা সরগরম হয়ে ওঠে সন্ধ্যায়। সে'দিন মাত্র দুজন সহকর্মী ছিলেন নিউজ রুমে। খানিক আগে তাঁদের চা খাইয়েছি বলে পিওন ছেলেটা ওদের আর হিশেবে ধরেনি। দু'কাপ চা-ই এনেছে।
সিঙ্গারা খাবেন কিনা জানতে চাইলে সেই দুজন না সূচক মাথা নেড়ে লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকলেন।
কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি বলে আমি আর নিলাম না সিঙ্গারা। শুধু চা খেতে খেতে গল্প করছি সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। মহিলা খুবই আলাপী। খুব অল্প সময়েই জানা হয়ে গেলো তিনি বিখ্যাত লেডি ব্র্যাবোন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্রী হয়েছিলেন জোর করে। মেয়ে বলে ভর্তি নিচ্ছিলো না কলেজ কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ তখন বিখ্যাত সাইদুর রহমান। প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান নামে যাঁর বিপুল খ্যাতি। শফিক রেহমানের বাবা। আমার সামনে বসা ভদ্রমহিলা প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকে ঝগড়া শুরু করলেন--মেয়ে বলে ভর্তি করে নেবেন না কেনো? মেয়েরা পড়াশুনা করবে না তাহলে? আমার যোগ্যতার পরীক্ষা নিন। তারপর অযোগ্য মনে হলে ফিরিয়ে দেবেন।
শেষমেশ প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান নিয়েছিলেন তাঁকে, ছাত্রী করে।
চা খেতে আরো জানা হলো এই নগন্য আমার তিনি একজন বর্ষিয়ান অনুরাগী। টোকা দিয়ে দেখলাম আমার সম্পর্কে বেশ ভালোই খোঁজ খবর রাখেন। এমন কি বিটিভির 'বর্ণালি' অনুষ্ঠানে আমার লেখা একটা নতুন গান প্রতি পর্বে থাকে সেটাও দেখলাম লক্ষ্য রাখেন তিনি। কার কাছ থেকে যেনো জেনেছেন এই পত্রিকায় আমি কাজ করি। আমাকে এখানে পাওয়া যায়। তাই আমার সঙ্গে দেখা করবার মানসেই এসেছেন তিনি।
আলাপের ফাঁকে ফাঁকে আমি খেয়াল করছিলাম মহিলা একটার পর একটা সিঙ্গারা খাচ্ছেন। পানির গ্লাসটাও শেষ করেছেন। চারটে সিঙ্গারা খেলেন তিনি বেশ দ্রুততার সঙ্গে। বুঝতে অসুবিধে হলো না ভদ্রমহিলা ক্ষুধার্ত। আমি খুব নিচু কণ্ঠে আরো ক'টা সিঙ্গারা বলি? জানতে চাইলে তিনি খানিকটা লজ্জিত হয়ে হাসলেন--না না। আর লাগবে না।
আমার সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলাম। এটা সেটা অনেক কথার পর তিনি চলে গেলেন। ভদ্রমহিলাকে আমার খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার বলে মনে হলো। আমার খোঁজেই এসেছেন কিন্তু আমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে না চেয়ে কিংবা কেনো এসেছিলেন সেটা না জানিয়েই চলে গেলেন তিনি। যাবার আগে অবশ্য বলে গেলেন--আরেকদিন আসবো। আমিও বলেছি--নিশ্চয়ই আসবেন আপা। যখন খুশি। দুপুরের পর থেকে বিকেলের দিকে আমাকে পাবেন।
এরপর মহিলা আসতে থাকলেন বেশ ঘন ঘন। তাঁকে আমাদের নিউজ রুমের প্রায় সবাই চেনে। সবাই জানে তিনি আমার খুব পরিচিত এবং কাছের একজন আপা। পিওন দারোয়ানরাও চেনে তাঁকে 'রিটন স্যারের গেস্ট' হিশেবে।
প্রথম দিনের পর থেকেই পিওন ছেলেটাকে আমার বলা ছিলো--এই আপা আসার সঙ্গে সঙ্গে চারটা সিঙ্গারা আর গরম চা দিবি। আমার বলার অপেক্ষা করবি না। এবং বিস্ময়কর ব্যাপার--প্রতিবারই আপা আসিবামাত্র পিওনের দেয়া চার চারটে সিঙ্গারা তিনি খেয়ে নিতেন পরম তৃপ্তিসমেত।
আপা আসেন। চা সিঙ্গারা খান। এটা সেটা অনেক গল্প করেন। তারপর চলে যান। এইরকমই চলছিলো। এর মধ্যে একদিন দুপুরের পর পর খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে আমার কাছে এলেন। চা সিঙ্গারা আসার আগেই খুব নিচু স্বরে বললেন--তোমার কাছে কি পঞ্চাশটা টাকা হবে?
হবে আপা হবে। আপনি বসেন তো আগে।
ততোদিনে তিনি আমাকে আপনি সম্বোধন বাদ দিয়ে তুমি সম্বোধন করা শুরু করেছেন।
খুব গোপনে আমি তাঁর হাতে পঞ্চাশটা টাকা গুঁজে দিলাম। সিঙ্গারা-টিঙ্গারা খেয়ে তিনি চলে গেলেন।
এক বিকেলে অফিসে এসে পিওনের কাছে শুনলাম--আজ দুপুরে আমি আসবার অনেক আগেই এসেছিলেন তিনি। 'চা সিঙ্গারা খাওয়াইছিলি ব্যাটা?' জিজ্ঞেস করতেই পিওন ছেলেটা বললো--না। চা খাওয়ানের আগেই চইল্লা গেছেন। তারপর খুব গোপন কথা বলার মতো করে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রায় ফিঁসফিঁস করে বললো--আপায় আইজগা বাথরুমে গিয়া গোসল করছে স্যার! তারপর তাড়াতাড়ি চইলা গেছে!
কদিন ধরে খেয়াল করছিলাম আপার সঙ্গে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা আগের চাইতেও স্বাস্থ্যবান আর ফাটুম ফুটুম হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে এমন ত্রাহি টাইট অবস্থা। এর মধ্যে আরো দু'দিন আমার কাছ থেকে পঞ্চাশ এবং একশো টাকা ধার করেছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম আপা খুব খারাপ একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নিজের থেকে না বললে আমি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত গোপন বিষয়ে জানতে আগ্রহী হতে পারি না। আমি তাই অপেক্ষায় থাকি।
একদিন আগ বাড়িয়ে বললাম--সেই প্রথম দিন থেকেই খেয়াল করেছি আপা আপনি আমাকে কী একটা বলবেন বলবেন করছেন কিন্তু বলছেন না। কাহিনি কী?
আপা বললেন নাহ্ তেমন কিছু না।
এরপরও আপা আসেন। মাঝে মধ্যে আমার কাছে চাইবার আগেই আমি পঞ্চাশ কিংবা একশো টাকার একটা নোট তাঁর হাতে গুঁজে দিই। খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনার মতো, যেনো এমনটাই হবার কথা ছিলো টাইপের ভঙ্গিতে তিনি টাকাটা নেন।
এক বিকেলে খুব দুখী একটা চেহারা নিয়ে আমার কাছে এলেন আপা। তারপর কেউ শুনতে না পায় এমন কণ্ঠে আমাকে বললেন--আমাকে একটা ওল্ড হোমে থাকার ব্যবস্থা করে দিবি রিটন?
(ততোদিনে আপা আমাকে তুমি থেকে তুই সম্বোধনে নেমে এসেছেন।)
এই প্রথম তিনি আমাকে তাঁর গভীর গোপন কষ্ট আর সংকটের কথা বলতে আগ্রহী হলেন।
আপার পুত্রকন্যারা একজন ছাড়া সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং ওয়েলএস্টাবলিস্ট। বিদেশেও থাকে কেউ কেউ। সবচে কনিষ্ঠপুত্রটি কলেজ পড়ুয়া(সম্ববত বি এ ক্লাশের ছাত্র)। কনিষ্ঠপুত্র আর তিনি থাকেন জ্যেষ্ঠপুত্রের সংসারে। আশ্রিত। জ্যেষ্ঠপুত্র এবং পুত্রবধু দু'জনেই চিকিৎসক। ঢাকার ন্যাশনাল হাসপাতালে কর্মরত দু'জনেই। পুত্রবধুর অপমান আর গঞ্জনা সহ্য করেই টিকে আছেন তিনি ওই সংসারে। আশ্রিত জীবন গ্লানি আর অবহেলার হয়। আপারও হয়েছে। কিছুটা স্ত্রৈণ স্বভাবের বিখ্যাত চিকিৎসক সন্তানটি স্ত্রী কর্তৃক জননী নিগ্রহের ব্যাপারে প্রকাশ্যে উদাসীন কিংবা বলা চলে অতিমাত্রায় ডিফেন্সিভ। মায়ের অপমানে পুত্র তাঁর বিচলিত হয় না। আবার মাঝেমধ্যে চিকিৎসক দম্পতি আপাকে নিয়ে ঝগড়াও করে ঘরের দরোজা বন্ধ করে। ঝগড়াটা অনুচ্চ কণ্ঠে হলেও সবই শোনা যায় পাশের ঘর থেকে। মজার ব্যাপার, ওরা ঝগড়া করে ইংরেজিতে। যাতে ওদের ছোট্ট দু'টি সন্তান সেই ঝগড়াটার কারণ ও বিষয়বস্তু বুঝতে না পারে। কিন্তু লেডি ব্র্যাবোনের ছাত্রী আপা তো সবই বোঝেন!
আপা বললেন—বুঝলি রিটন ইংরেজিটা যদি না বুঝতাম তাহলে কত্তো ভালো হতো বল তো দেখি! আমি বুঝতেও পারতাম না কী জঘন্য আর কুৎসীত কথাবার্তা ওরা বলছে আমাকে নিয়ে! আমি যে ইংরেজি বুঝতে পারি সেটা তো ওদের অজানা নয়! তাই কষ্টটা খুব বেশি আঘাত করে রে এই বুকের মধ্যে! স্বামীটা মরে গিয়ে আমাকে ছেলের সংসারে বোঝা বানিয়ে দিয়ে গেলো! কী লাভ হলো এম এ পাশ করে! সেই তো ছেলের সংসারে আশ্রিতই হলাম শেষ জীবনে!
টানা এতোগুলো কথা বলার সময় আপার কণ্ঠস্বর বারকয় কেঁপে কেঁপে উঠলেও চোখে তাঁর অশ্রু ছিলো না। কিন্তু--'জানিস আমার ছোট্ট দুটি দাদুভাইয়ের জন্যে কিছু কিনে নিয়ে গেলে পুত্রবধু সেগুলো ওদের খেতে দেয় না। কারণ ওগুলো খুব কমদামী। সস্তা খাবার।' বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন আপা।
আমি তাঁর চিকিৎসক পুত্রের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আপা আমার হাত চেপে ধরলেন—প্লিজ তুই ওকে ফোনও করবি না ওর সঙ্গে দেখাও করবি না ওর সঙ্গে কোনো কথাও বলবি না।
আপাকে চিন্তিত দেখাচ্ছিলো কারণ তিনি তাঁর পুত্রের নামটা এক ফাঁকে উচ্চারণ করে ফেলেছিলেন। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম—আপনি না চাইলে আমি যোগাযোগ করবো না আপনার ছেলের সঙ্গে। ট্রাস্ট মি আপা।
আপার সামনেই ইত্তেফাকের ফাইল ঘেঁটে বিজ্ঞাপনের পাতা তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটা ওল্ড হোম বা প্রবীন নিবাসের ফোন নাম্বার পাওয়া গেলেও মুদ্রিত ফোন নাম্বারে কল করে কাউকে ধরাই গেলো না। পরদিন আবার করবো বলে ক্ষ্যান্ত দিলাম। বিষণ্ণ আপাকে খুশি করতে বললাম—আমাদের পত্রিকায় আপনার সম্পর্কে বড় একটা প্রতিবেদন ছাপাবো আপা। ভয় ণেই ছেলের বিরুদ্ধে কিছু লিখবো না। আপনার সংগ্রামী জীবন নিয়ে লিখবো। আপনার বড় একটা সাক্ষাৎকারও থাকবে সঙ্গে। শুনে আপা খুশি হয়ে উঠলেন—আমার ছবিও ছাপবি? বললাম—ছাপবো।
নিউজ প্রিন্টের প্যাডে ঝটপট কয়েকটা প্রশ্ন লিখে আপার হাতে ধরিয়ে দিলাম—এরপর যেদিন আসবেন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখে নিয়ে আসবেন।
কয়েকদিন পর আপা প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখে নিয়ে এলেন। আমি আপাকে নিয়ে একটা ভূমিকা সমাপ্তি ইত্যাদি লিখে প্রশ্নোত্তরগুলো তার সঙ্গে রিলেট করে দিলাম। বেশ বড়সড় একটা রচনাই দাঁড়িয়ে গেলো। শিরোনাম দিলাম—এক অপরাজিতার গল্প টাইপের কিছু একটা। ব্রড শিটের অর্ধপাতা জুড়ে ছাপা হলো অপরাজিতার গল্প, ছবিসহ।
পরের সপ্তাহে প্রেসক্লাবের সামনে এক সমাবেশে নারী নেত্রী মালেকা বেগম আমাকে বললেন—আপনার লেখা অপরাজিতার কাহিনি পড়েছি। ওই ভদ্রমহিলার ফোন নাম্বার বা ঠিকানাটা আমাকে দিতে পারেন? আমি বললাম—আমার কাছে নেই তবে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবো।
আপা আমাকে তাঁর ঠিকানা বলেননি কখনো। কোনো ফোন নাম্বারও দেননি। আমি তাঁর প্রতীক্ষায় থাকি। পিওন ছেলেটাকে বলে রেখেছি--আপা এলে চা সিঙ্গারা খাওয়াবি আর তাঁর ঠিকানাটা নিয়ে রাখবি। বলবি আমার খুব দরকার।
আমি প্রতীক্ষায় থাকি। কিন্তু আপা আর আসেন না।
এর মধ্যে একদিন সম্পাদকের সঙ্গে কথাকাটাকাটির পর স্বভাব মোতাবেক চাকরির নিকুচি করে চলে এলাম বাংলাবাজার অফিস থেকে। আর গেলাম না। এমনকি ড্রয়ারে থাকা আমার জরুরি জিনিসপত্রগুলো আনতেও গেলাম না আর।
আপার সঙ্গে আর দেখা হলো না আমার। পিওন ছেলেটার সঙ্গে টেলিফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করে জেনেছি--সেই আপা আর কখনোই আসেননি আমার খোঁজে, বাংলাবাজার পত্রিকা অফিসে।
আপা কি সহসা মৃত্যুবরণ করেছিলেন?
তাঁর মৃত্যু কি স্বাভাবিক ছিলো?
আমার জানা হয়নি।
(আজ আপার কথা কী কারণে জানি না খুব মনে পড়ছিলো। আমার স্মৃতিশক্তি বরাবরই খুব ভালো। কিন্তু বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে--আপার নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। লেখার শুরু থেকেই তাঁর নামটা খুঁজে বেড়াচ্ছি। সমাপ্তিতে এসে শুধু এইটুকু মনে পড়লো--তাঁর নামের একটা অংশ ছিলো খায়ের। স্বামীর নামের সেই অংশটা নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে রেখেছিলেন আপা।)
২২ আগস্ট ২০১৫
আলোকচিত্র/ইফতেখার মাহমুদ
ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী--০১
জনযুদ্ধের গণযোদ্ধাদের হৃদয়স্পর্শী কাহিনির অপরূপ কথক মেজর কামরুল
লুৎফর রহমান রিটন
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির অনিন্দ্যসুন্দর এক সকাল। বইমেলা উপলক্ষে আমি তখন ঢাকায়। প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’ বইয়ের লেখক মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া আমাকে ফোন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের দুর্দান্ত স্টোরি টেলার মেজর কামরুল আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন—‘তোমার শাপলা আপা বইমেলা থেকে ‘একুশের ছড়া স্বাধীনতার ছড়া’ নামে তোমার লেখা একটা ছড়ার বই কিনে এনেছে। বইটা পড়ছিলাম। এই আমি একাত্তরে রণাঙ্গণে সহযোদ্ধার রক্তাক্ত লাশ বহন করার সময়ও এতোটা কাঁদিনি, তোমার ‘শহিদ মিনার জানে’ ছড়াটা পড়ে আজ যতোটা কাঁদলাম।’
টেলিফোনের অপর প্রান্তে কামরুল ভাই তখনো কাঁদছিলেন! কী বলবো আমি? তাঁকে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে আছি।
কিছুক্ষণ পর লাইন কেটে দিলেন মেজর কামরুল।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের স্টোরি টেলার কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বহুদিনের। বন্ধু আবু হাসান শাহরিয়ারের বড় বোন ছড়াকার রিফাত নিগার শাপলার স্বামী হিশেবে তিনি আমাদের কাছে দুলাভাই গোত্রের হলেও সম্পর্কটা কোনোদিনই শালা-দুলাভাই গোছের ছিলো না। দেখা সাক্ষাৎ খুবই কম হতো আমাদের।
১৯৯১ সালে আমি কাজ করতাম 'দৈনিক বাংলা বাজার' নামের একটা পত্রিকায়। পত্রিকাটার ফিচার এডিটর ছিলাম। ছোটদের সাপ্তাহিক পাতা 'হইচই' বেরুতো আমার সম্পাদনায়। আমাদের অফিস ছিলো গ্রিণ রোডে। এক দুপুরে মেজর কামরুল হাসান এলেন আমার দফতরে। এটা-সেটা ব্যাক্তিগত আলাপের এক পর্যায়ে জানতে পারলাম মর্মান্তিক সংবাদটি। তাঁদের পুত্র সাবিত মারা গেছে। সাবিতকে হারিয়ে কামরুল-শাপলা দম্পতির সংসারটি শোকের সাগরে ভাসছে। শাপলা আপা খুব এলোমেলো হয়ে পড়েছেন। বললাম একবার দেখতে যাবো। কামরুল ভাই একটা খাম আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। খামের ভেতরে সাবিতকে নিয়ে কামরুল ভাইয়ের একটা স্মৃতিগদ্য আর সাবিতের একটা ছবি। সন্তানহারা পিতার হাহাকার ভরা লেখা। পড়তে গেলে হৃদয় প্লাবিত হয়। ওখানে সাবিতের কবরের বর্ণনাটা পড়তে গিয়ে খেয়াল করলাম কী রকম ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো ফুলস্কেপ কাগজে বাংলায় টাইপ করে আনা অক্ষরগুলো।পরের সপ্তাহেই লেখাটা আমি ছেপে দিলাম 'হইচই'-এর পাতায়।
যেদিন লেখাটা ছাপা হলো সেদিন দুপুর ১২টার দিকে কামরুল ভাই এলেন। আমাকে বারবার করে ধন্যবাদ দিলেন। সার্কুলেশন বিভাগ থেকে একগাদা পত্রিকা কিনে নিলেন। তারপর আমাকে বললেন--চলো। তোমার আপাকে একবার দেখে আসবে বলেছিলে।
আমি বললাম--আরেকদিন যাই কামরুল ভাই?
কামরুল ভাই বললেন--না। আজকেই এবং এখনই আমার সঙ্গেই যাবে তুমি। তোমার আপা সকালেই লেখাটা পড়েছে। অনেক কান্নাকাটি করেছে। আমি তোমার কথা বলেছি। তুমি গেলে খুব খুশি হবে তোমার আপা।
সদ্য সন্তানহারা পিতার কণ্ঠে গভীর প্রত্যয় ছিলো আর মমতা ছিলো। এই কণ্ঠকে ফেরানো যায় না।কথা না বাড়িয়ে কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে রওনা হলাম তাঁর ডিওএইচএস-এর বাড়ির উদ্দেশ্যে। কামরুল ভাইই ড্রাইভ করছিলেন। সেনা সদস্য হলেও তিনি তখন সম্ভবত ডিজি এন্টি করাপশন। রোদ ঝকঝক দুপুরে কামরুল ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে শাপলা আপাকে দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো। প্রাণহীন একটা দেহ যেনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। অনেক শুকিয়ে গেছেন। তাঁর লম্বা চুলগুলো বরাবরের মতো পরিপাটি নয়। কথা বলছেন কী রকম দূরের মানুষের মতো। যেনো বা অনেক দূর থেকে তিনি আমাকে দেখছেন। আমি তাঁর নাগালের মধ্যেই বসে আছি কিন্তু মনে হচ্ছিলো মহাসিন্ধুর ওপার থেকে তিনি কথা বলছেন। সারাক্ষণ শুধু সাবিতকে নিয়েই কথা বলে চললেন। নাগারে দীর্ঘক্ষণ তিনি তাঁর সদ্য হারানো পুত্রের কথা বললেন। বলতে বলতে হাসলেন। বলতে বলতে কাঁদলেন। তাঁর স্মৃতিচারণায় আমি বেশ কয়েকবার যেনো বা জীবন্ত সাবিতকে দেখতে পেলাম সেই ঘরে। আহারে! পুরো ঘর জুড়ে সাবিতের স্মৃতি। পুরো ঘর জুড়ে সাবিতের শূন্যতা।
সেই দুপুরে বিষণ্ণ ডায়নিংটেবিলে আমাকে জোর করে বসিয়ে দিলেন কামরুল ভাই। শাপলা আপা সাবিতের কথা বলতে বলতেই আমাদের দু'জনকে খাবার দিলেন। খেতে ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু খেতেই হলো। সদ্য সন্তান হারানো দুজন বাবা-মাকে সন্তুষ্ট করতে খেতেই হলো আমাকে। বাইরে তখন দুপুরের ঝকঝকে রোদ থাকলেও ঘরের ভেতরটা ছিলো কী রকম ধুসর। ডায়নিং টেবিলটা ছিলো আরো ধুসর। খুদে এক বালকের অনুপস্থিতি পুরো বাড়িটাকে নিরানন্দশূন্যতায় ভরিয়ে রেখেছিলো।
২।।
শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার দেখা হয় না। কথা হয় না। দিনের পর দিন ওর সঙ্গে আমার সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও কামরুল ভাই আর শাপলা আপার সঙ্গে কী করে কী করে যেনো যোগাযোগটা থেকেই যায়।
প্রতিবার একুশের বইমেলায় শাপলা আপার সঙ্গে আমার দেখা হয়। কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়।শাহরিয়ারের বড়বোন রিফাত নিগার শাপলা আমাকে তাঁর ছোটভাইয়ের বন্ধু হিশেবে একেবারে ছোটভাইয়ের মর্যাদাটাই দেন এখনো। প্রতিবার বইমেলায় তিনি আমার জন্যে সুন্দর সুন্দর ফতুয়া কিনে নিয়ে আসেন। সেগুলোর একটাও আমার শরীরের মাপে হয় না। শাপলা আপা আমাকে আগের সেই ছোটবেলার রিটন হিশেবেই দেখেন এবং ভাবেন। আমি যে বড় হয়েছি সেটা আপার চোখেই পড়ে না। তিনি ছোট ছোট ফতুয়া নিয়ে আসেন। আমি খুশি হয়ে হাসিমুখে গ্রহণ করি শাপলা আপার ভালোবাসার উপহার। একুশের বইমেলার সময় মাঝে মধ্যেই বিকেলে বা সন্ধ্যায় শাপলা আপা আসেন। বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রের সামনে অর্থাৎ বর্ধমান হাউসের সিঁড়িতে আমার পাশে এসে বসেন। তারপর ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর থেকে আঙুর আপেল কিংবা কমলার কোয়া বের করে আমার হাতে গুঁজে দেন।'ছোট ভাইয়ের বন্ধুও ছোটভাই' থিয়োরিতে শাপলা আপা আশির দশক থেকে সেই যে ছোটভাই বানিয়ে রেখেছেন আমাকে, আজও আমি তাঁর সেই ছোটভাইটিই আছি।
কামরুল ভাই বইমেলায় আসেন নিয়মিত। তাঁর একটা স্টল থাকে প্রতি বছর। মুক্তিযুদ্ধের গবেষণামূলক একটা প্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। সেই প্রতিষ্ঠানে কেবলই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই থাকে। কামরুল ভাই সেই স্টলের সামনে একটা চেয়ারে বসে থাকেন।
বইমেলার মাঠ থেকে প্রতিদিন বিকেলে চ্যানেল আই একটা লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। সেই অনুষ্ঠানটির নিয়মিত উপস্থাপক হিশেবে আমি প্রতিদিন বিকেলে বইমেলায় উপস্থিত থাকি। প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানে অন্তত একবার হলেও আমি মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হাসান ভূঁইয়ার সাক্ষাৎকার নিই। মেজর কামরুলের শারীরিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের অনুষ্ঠানের সংরক্ষিত ক্যাসেটে কামরুল ভাইয়ের বাৎসরিক শারীরিক পরিবর্তনের ধারাবাহিক চিত্রমালা অবলোকন করে আমি বিস্মিত হয়েছি। ইদানিং বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না কামরুল ভাই। আমাদের অনুষ্ঠানে বসবার কোনো ব্যবস্থা নেই। সরাসরি সম্প্রচারের আগ মুহূর্তে কামরুল ভাইকে এনে দাঁড় করাই। বছর দুই আগে, সেই রকম এক বিকেলে কামরুল ভাই এলেন। তিনি খুবই উত্তেজিত। কোনো কারণে প্রচণ্ড রেগে আছেন। আমার ওপরও খানিকটা রাগ ঝাড়লেন। ভেবেছিলাম সম্প্রচার শুরু হলে অন ক্যামেরা তিনি ঠিক হয়ে যাবেন। কিন্তু সেটা হলো না। রাগত স্বরে তিনি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। লাইভ অনুষ্ঠান। কোটি কোটি মানুষ সেটা দেখছেন। আমি তাঁর রাগের বা ক্ষোভের কারণটা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন—তোমরা চ্যানেল আই একজন লাক্স সুন্দরী মডেলকে দাও তিন লক্ষ টাকা আর মুক্তিযোদ্ধাদের দশ হাজার টাকা! মুক্তিযোদ্ধাদের আর কতো অপমান করবে? আমি বললাম—কামরুল ভাই মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির গৌরব। মুক্তিযোদ্ধারা পুরো জাতির শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাসিক্ত। আপনারা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের মাথার মুকুট। লাক্সসুন্দরী মডেলরা কিন্তু জাতির শ্রদ্ধার পাত্র নয়! মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তথাকথিত মডেলদের এই তুলনাটা আসে কী করে? বাণিজ্যিক একটা বিষয়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধারা তুলনীয় হতে পারে না কামরুল ভাই। কর্পোরেট কালচারের আধিপত্য ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর স্পন্সরশীপের কল্যাণে একজন লাক্সসুন্দরীর বাজারিমূল্য যতোই বেশি হোক না কেনো সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এক কাতারে তুলনীয় নয় তারা। তারা আজ আছে কাল নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা আছেন স্বাধীন দেশের কোটি মানুষের চিরকালের মুকুট হয়ে।
আমার এরকম কথায় ও যুক্তিতে শান্ত হলেন কামরুল ভাই। আসলে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধার অবমাননা সইতে পারেন না বলেই দেশের সামগ্রিক অধঃপতিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বজ্জাতি ও হ্যাংলামি তাঁকে ক্ষুব্ধ ও অসুস্থ করে তোলে।
৩।।
কয়েক বছর আগে চ্যানেল আই-এর তেজগাঁও কার্যালয়ে সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আমীরুল ইসলামের কক্ষে এক বিকেলে মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা কয়েকজন। কামরুল ভাই বলছিলেন যুদ্ধ দিনের অপরূপ কথা। অভিভূত হয়ে শুনছিলাম আমরা। যাঁরা তাঁর লেখা 'জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা' বইটি পড়েছেন তাঁরা জানেন মুক্তিযুদ্ধের কতো অসাধারণ সব গল্প আছে তাঁর স্মৃতিতে। খুব তরুণ বয়েসে তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। একাত্তরে তিনি যখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তখনই এসেছিলো দেশমাতৃকার ডাক। কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন হায়দারের সহযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তিনি একাত্তরের আশ্চর্য সেই দিনগুলোর অবিস্মরণীয় লড়াইকে সেনাবাহিনির কৃতিত্ব হিশেবে দেখতে রাজি নন। তিনি বিশ্বাস করেন মৃত্তিকা থেকে উঠে আসা সাধারণ কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র এবং লেখাপড়া না জানা গ্রাম-গঞ্জের গরিব দুখি সাধারণ মানুষদের বিপুল অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের কারণেই অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটা জনযুদ্ধ ছিলো। জনযুদ্ধের গণযোদ্ধারা স্বাধীন দেশে কোনো মর্যাদা পায়নি। স্বীকৃতি পায়নি। তিনি তাই অবিরাম বলে গেছেন যুদ্ধদিনের গল্প, যে গল্পের নায়ক কোনো মেজর-কর্ণেল-ব্রিগেডিয়ার কিংবা মেজর জেনারেল নয়, যে গল্পের নায়ক সাধারণ গণযোদ্ধারা।
কামরুল ভাইয়ের গল্প-কাহিনি মোটেও কোনো কল্প-কাহিনি নয়। কামরুল ভাই সুযোগ পেলেই সেই গল্পগুলো বলেন। হৃদয়স্পর্শী একেকটা গল্প, আত্মদানের। শুনতে শুনতে ভিজে ওঠে চোখ। জেগে ওঠে দ্রোহ। তাঁর মতো মুক্তিযুদ্ধের স্টোরি টেলার বা গল্প-কথক দ্বিতীয়টি নেই। তাঁদের সময়ের সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। কামরুল ভাইও চলে গেলে রণাঙ্গণ থেকে উঠে আসা কথক আর থাকবে না।
সেই আড্ডায় আমীরুলের প্রস্তাব ছিলো--কামরুল ভাইয়ের বলা এবং জানা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিগল্পগুলোকে বিষয় করে একটা একক অনুষ্ঠান হতে পারে টেলিভিশনের জন্যে। অন ক্যামেরা কামরুল ভাই বলে যাবেন যুদ্ধদিনের গল্পগাঁথা। প্রতিদিনের সেগমেন্ট হিশেবে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবে চ্যানেল আইতে। কামরুল ভাই রাজি হলেন মুহূর্তেই। কী নাম হবে অনুষ্ঠানের? কী নাম দেয়া যায়? বেশ কয়েকটি নাম প্রস্তাবিত হলো। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্ক্তি ধার করে আমি বললাম—এই অনুষ্ঠানের নাম হতে পারে--'তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা'। কামরুল ভাই সঙ্গে সঙ্গেই লুফে নিলেন নামটা।
এর কিছুদিন পর চ্যানেল আই-তে দীর্ঘদিন ধরে প্রচারিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হাসান ভূঁইয়ার অপরূপ কথনে 'তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা' নামের ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানটি। মিনিট পাঁচেক সময়। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের আয়োজনটির ব্যাপকতা ছিলো বিপুল-বিশাল। সময়ের স্বল্পতার কারণে এডিটেড ভার্সন সম্প্রচারিত হলেও চ্যানেল আই-আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে যোদ্ধা কামরুলের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের অপরূপ দলিলগুলো।
৪।।
মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকে 'ছড়া ও ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ' নামে আমার একটা ছড়ার বই বেরিয়েছিলো ১৯৮৯ সালে। এই সংস্থা থেকেই বেরিয়েছিলো 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' নামের ঐতিহাসিক বইটি। আমার ছড়ার বইটির মুদ্রণ বহু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ওটা বইয়ের বাজারে আর পাওয়া যাচ্ছিলো না। ২০১২ সালে বইটার নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো 'শব্দশৈলী' থেকে। নতুন সংস্করণে উৎসর্গের একটি পাতা সংযুক্ত হয়েছে। বইটির উৎসর্গপত্রে আমি লিখেছি--'যুদ্ধদিনের কাহিনি-কথক একাত্তরের রণাঙ্গণে অস্ত্রহাতে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া'। তাঁকে উৎসর্গ করা আমার বইটি হাতে পেয়ে একজন শিশুর মতোই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন কামরুল ভাই। লম্বা শশ্রুমণ্ডিত মাওলানা টাইপ কামরুল ভাইয়ের হাসিটা দারূণ। বইটির পাতা উলটে উৎসর্গ পাতায় নিজের নামটি আবিস্কার করে অভিভূত হাস্যোজ্জ্বল কামরুল ভাই বইমেলার মাঠে আমাকে গভীর আলিঙ্গণে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন অনেকক্ষণ ধরে।
আমার এই জীবনে খুব অল্প সংখ্যক বড় ধরণের প্রাপ্তির মধ্যে এই আলিঙ্গণটি অন্যতম। মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার মতো একজন দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে অভিভূত করতে পারাটাও সেরা অর্জন, আমার কাছে।
প্রিয় কামরুল ভাই, জননী জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে একদিন যে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন সেই হাতেই পরবর্তীতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। আপনার কলমে মূর্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অপরূপকথা। আপনার সোনার কলমটি আরো দীর্ঘদিন সচল সজীব থাকুক। অব্যাহত থাকুক আপনার গল্প বলা।
আজ আপনার জন্মদিনে আটলান্টিকের এপার থেকে অনেক অনেক শুভ কামনা।
অটোয়া ২৪ মে ২০১৫
[আলোকচিত্র/এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া এবং রিফাত নিগার শাপলা।]
চাকর বিষয়ক
লুৎফর রহমান রিটন
ওদের, অস্থি-মজ্জা-রক্তস্রোতে দাসত্বেরই আকর
আচরণে আর স্বভাবে ওরা হচ্ছে চাকর।
পোশাকে কেউ স্যুটেড-বুটেড কেউ বা শাদামাটা
একখানে মিল, ওদের দুইয়ের কমন চাহিদাটা।
স্বদেশ এবং প্রবাসেও ওদের দেখা যায়
খুব সহজেই বুঝবে তুমি উহারা কী চায়!
রাজনীতিবিদ নেত্রী-নেতা বিদেশ বিভূঁই এলে
আলোচ্য এই চাকরগণের নিত্য দেখা মেলে।
এয়ারপোর্টে থাকবে ওরা দাঁড়িয়ে সারি সারি
দৌঁড়ে ওরা ফলো করবে নেত্রীপ্রভূর গাড়ি।
বাড়ির সমুখ হোটেল লবি চাকরে সয়লাব
(এমন কি ভাই চায় না যেতে করিতে প্রস্রাব!)
নাওয়া-খাওয়া-চাকরি ভুলে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়--
একটু যদি নেত্রী-নেতার দৃষ্টি পাওয়া যায়!
দিবানিশি রক্ত-ঘামের পরিশ্রমের আয়ে
দামি দামি গিফট্ ঢেলে দেয় নেতার শুভ্র পায়ে...
(চাকররা হয় ভোদাইচন্ডি চাকররা বুরবক!)
নেত্রীকে দেয় নিজের বউ আর ছেলেমেয়ের হক!
ভক্তিরসে সিক্ত করে নেত্রীপ্রভূর চরণ
এইটা ওদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার ধরণ।
অন্য দলের নেত্রী এলেও এয়ারপোর্টে গিয়ে
বিরুদ্ধে তাঁর শ্লোগান দেবে প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে!
যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যসহ নানান দেশে
পুঙ্গবেরা আবির্ভূত একই রকম বেশে।
চিরকালীন দাসত্বছাপ ললাটজুড়ে আঁকা
পার্টি থাকে বাংলাদেশে, হেথায় থাকে শাখা!!
দূর প্রবাসের বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র কিংবা পাতি
এয়ারপোর্টে দেয় বুঝিয়ে ওরা বীরের জাতি।
হৈ-হুল্লোড় ধাক্কাধাক্কি ধাওয়া পালটা ধাওয়া
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে আর যাবে না পাওয়া...
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
গরু তুমি
লুৎফর রহমান রিটন
গরু তুমি কোনো দেশেতে থাকো?
তোমায় যেনো চিনতে পারি নাকো!
বৎসরান্তে তোমার দেখা মেলে
তুমি আসো ঈদের সিজন এলে।
তোমায় নিয়ে রোজই নিউজ হয়
আদি নিবাস বাংলাদেশে নয়
প্রতিবেশী রাষ্ট্র মানে ভারত
ভারত হচ্ছে গরুর সেরা আড়ত
এত্তো গরু! উদবৃত্তই থাকে
তোমরা আসো তাই তো ঝাঁকে ঝাঁকে!
যখন তখন হাম্বাটে ডাক ছাড়ো
যেথায় সেথায় ভ্রমণ করতে পারো
এই সিজনে মানুষ হারায় দিশা
তাই লাগে না পাসপোর্ট আর ভিসা
ট্রাভেল ডকুমেন্টও লাগে নাতো!
তোমার তো নেই উচ্চ-নিচু জাতও।
নেই তোমাদের সংঘ ইউনিয়ন
নেই তোমাদের ধর্ম রিলিজিয়ন।
জাতীয়তার নেই ঝামেলা কোনো
নেই তোমাদের নিরাপত্তা জোনও।
তোমরা হলে ব্যতিক্রমী নেশন
বর্ডারে হয় ইজি ইমিগ্রেশন!
দু'বর্ডারে লাভটা আধা আধা
ব্যস্ত থাকে ভাইজান আর দাদা।
তোমায় নিয়ে দু'দল পেরেশান
সেথায় হিন্দু হেথায় মুসলমান...
রহস্যময় এই পৃথিবীর রসিকতাও হেভি
হেথায় নিছক খাদ্য তুমি, হোথায় তুমি দেবী!
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যুগ্ম সচিব স্বরাষ্ট্র বনাম পিওন আলমগীর
অপ্রকাশিত রচনা থেকে--০১
যুগ্ম সচিব স্বরাষ্ট্র বনাম পিওন আলমগীর
লুৎফর রহমান রিটন
একটি দৈনিকসহ চারটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খবর হাউসে আর্টিস্ট অর্থাৎ শিল্পী ছিলেন মাত্র একজন—হামিদুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় পাশ করেও হামিদুল ইসলাম শিল্পী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। চমৎকার লেটারিং ছিল তার। ফ্রি হ্যান্ড লেটারিং-এ শিল্পী কাজি হাসান হাবিবের পর হামিদুল ইসলামই ছিলেন স্বমহিমায় অনন্য। এখনও পাক্ষিক অনন্যা পত্রিকায় তার দৃষ্টিনন্দন ডিজাইনের পাশাপাশি ফ্রি হ্যান্ড লেটারিং দেখে মুগ্ধ হতে হয়। খবর যখন সাপ্তাহিক ছিল, তখনও তা ছিল ব্রডসিট পত্রিকা। সাপ্তাহিক খবর-এ আট কলাম ব্যাপী ছাপা হতো ব্যানার হেডিং। তখন ফটোকম্পোজ বা কম্পিউটার কম্পোজের সুবিধে ছিল না। পত্রিকা ছাপা হতো হ্যান্ড কম্পোজে। কম্পোজ করা ম্যাটার সেলোফিন পেপারে তুলে তা থেকে প্লেট বানিয়ে ছাপতে হতো পত্রিকা। আর ব্যানার হেডিং-এর জন্যে কাঠের টাইপ ছিল ভরসা। কাঠের বড় বড় হরফগুলো নিট ছিল না। ফলে পত্রিকায় একজন আর্টিস্ট থাকাটা ছিল জরুরি। ইলাস্ট্রেশন ছাড়াও আর্টিস্টের অন্যতম প্রধান কাজ হেডিংগুলোর টাইপোগ্রাফি অংকন। টাইপোগ্রাফি অংকনে অর্থাৎ ছাপার হরফের মতো অক্ষরগুলো ঠিকঠিক মাপ মতো আঁকার ক্ষেত্রে হামিদুল ইসলামের অনায়াস দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। হ্যান্ডকোম্পাজ থেকে ফটোকম্পোজ এবং কম্পিউটার কম্পোজের আবির্ভাবে শিল্পী হামিদুল ইসলাম পরিত্রাণ পেয়েছিলেন হেডিং অংকনের ঝামেলা থেকে। তবে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলোর প্রচ্ছদ ডিজাইন করতে হতো তাকেই। ফলে প্রতিসপ্তাহে তিন চারটি পত্রিকার কভার ডিজাইন করতে করতে এক পর্যায়ে তিনি টাইপড হয়ে গেলেন খুবই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক কারণে। শেষ দিকে অবশ্য মামুনুর রশীদ নামে আরেকজন আর্টিস্ট পার্ট টাইমার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন খবর হাউসে। কিন্তু তারও করার কিছু ছিলনা নতুনত্ব বা বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে। কারণ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলোর ধরন ধারণ এমনই ছিল যে তাদের প্রচ্ছদকে ফর্মুলা বা ছকের বাইরে নিয়ে আসাটা সহজ ছিল না। ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে আমি যোগদান করলাম সাপ্তাহিক মনোরমা নামের পত্রিকাটির ঘোস্ট এডিটর বা ভূত-সম্পাদক হিসেবে। নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও প্রিন্টার্স লাইনে নাম যাবে না। সম্পাদক হিশেবে শুধু মিজানুর রহমান মিজান কিংবা ফুল্লরা বেগম ফ্লোরার নামটিই মুদ্রিত হবে। সেই হিশেবে আমিও একজন ঘোস্ট এডিটর হিশেবেই যোগ দিলাম খবর হাউসে। দায়িত্বে আছি বটে সাপ্তাহিক মনোরমার, কিন্তু নাম নেই প্রিন্টার্স লাইনে। এই ভবন থেকে বেরুনো অন্যান্য সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর থেকে মনোরমাকে আলাদা করার জন্য প্রচ্ছদটি অন্যরকম হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে হলো আমার প্রথমেই। কথাটা জানালাম খবর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজানকে। ফুলটাইম আর্টিস্ট হামিদ এবং পার্টটাইম মামুন থাকতেও তৃতীয় একজন আর্টিস্টকে নিয়ে আমি কাজ করতে চাই শুনে মিজান ভাই ভড়কে গেলেন—
—আরো একজন আর্টিস্ট? একটি নতুন সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্যে আলাদা আরেকজন আর্টিস্টকে চাকরি দিতে হবে?
—না মিজান ভাই চাকরি দিতে হবে না। তিনি অন্য একটি বিখ্যাত ভবনে চাকরি করছেন অলরেডি।
—কোন বিখ্যাত ভবন?
—অবজারভার ভবন। আগে, দৈনিক পূর্বদেশ যখন বেরুতো তখন পূর্বদেশেও কাজ করতেন। এখন শুধু চিত্রালীতে কাজ করেন।
—নাম কি তার?
—সৈয়দ এনায়েত হোসেন। খুবই বিখ্যাত শিল্পী। অসাধারণ শিল্পী।
—টাকা-পয়সা কেমন দিতে হবে? বেশি কিন্তু দিতে পারবো না।
—বেশি দিতে হবে না।
—অল্প দিলেই চলবে?
—জি মিজান ভাই চলবে। অল্প দিলেই চলবে। কিন্তু টাকা না দিলে একদমই চলবে না।
—সো নাইস। অল্প টাকায় হলে আপত্তি নাই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না হামিদ-মামুন থাকতে...
—ওদের দুজনকে আমি অস্বীকার করছিনা। তারা নিঃসন্দেহে ভালো আর্টিস্ট। কিন্তু আমি যেমনটি চাই, আমার যা পরিকল্পনা, তাতে সৈয়দ এনায়েত হোসেন ছাড়া ইম্পসিবল।
—ঠিক আছে। নো প্রবলেম।
দুই
সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এমন যে আমার কোনো কথাই ফেলার সাধ্য তার নেই। ওটা জেনেই আমি এনায়েত ভাইয়ের মতামত না নিয়েই মিজান ভাইয়ের সঙ্গে তার ব্যাপারটি ফাইনাল করেছি। অবজারভার ভবনের চিত্রালী অফিসে এসে তাকে পটিয়ে ফেললাম চার মিনিটের মাথায়—
—হয় চিত্রালীতে আজই এক্ষুনি আমাকে একটা চাকরি দেন অথবা সাপ্তাহিক মনোরমায় আমার যে চাকরিটা হয়েছে সেটা রক্ষা করেন। চাকরি আমার যায় যায়।
—তোমার চাকরি আমি রক্ষা করবো কিভাবে?
—মনোরমার প্রচ্ছদ ডিজাইনটি প্রতি সাপ্তাহে আপনি করে না দিলে আমার সদ্য হওয়া চাকরিটা খোয়া যাবে।
—খবর ভবনে আর্টিস্ট আছে না?
—আছে, তবে সৈয়দ এনায়েত হোসেন নেই।
—পটাইতাছো? আচ্ছা দিমুনে কইরা প্রচ্ছদ, এইবার যাও।
—যাও মানে?
—চিত্রালীর কাজের বহুল প্রেসার।
—আপনি আমাকে চলে যেতে বলছেন এনায়েত ভাই। লোকে আমাকে ডেকে পায় না আর আপনি কিনা আমাকে চলে যেতে বলছেন? কাজের প্রেসার এর অজুহাতে! আমারতো ব্লাড-প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে ওস্তাদ...
—আরে থামো থামো। বইস্যা থাকো। সারাদিন বইস্যা থাকো। আমি আমার কাজ করতে থাকি।
—হ্যাঁ কাজ করতে থাকেন। তবে আপনার কাজ না। প্রথমে আমার কাজ।
—তোমার কাজ মানে?
—আমার কাজ মানে মনোরমার কাজ।
—মনোরমা বেরুতে তো আরো একমাস বাকি।
—আর সে কারণেই মাসব্যাপী বিজ্ঞাপন যাবে দৈনিক খবরসহ অন্যান্য পত্রিকায়। দুই কলাম ছয় ইঞ্চি। আপনি জাস্ট দুটো কার্টুন এঁকে দেবেন। ম্যাটার আমি বসিয়ে নেব।
—তোমার মনোরমার চাকরি বাঁচাতে তো দেখছি এখন আমার চিত্রালীর চাকরিটাই যায় যায়। চিত্রালীতে বসে আমি করবো মনোরমার কাজ?
—জি করবেন। আপনার কলিগ চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা তো চিত্রালীতে বসেই ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখেন। তো আপনি ক্যানো পারবেন না?
—নাহ্ তোমার হাত থেইকা নিস্তার নাই। ঝটপট কও কি আঁকতে হইব।
—সৈয়দ এনায়েত হোসেন পেন্সিল-স্কেল নিয়ে দুই কলাম ছয় ইঞ্চি মাপটাকে এনলার্জ করে নিলেন দ্রুত। তারপর বললেন—
—বইলা ফালাও ঝটপট।
আমি তাকে ব্যাখ্যা করলাম আমার আইডিয়াটা। দুটি বিজ্ঞাপন যাবে পত্রিকায় এভ্রি অলটারনেটিভ ডেতে। প্রথম দিনের মূল শিরোনাম ‘পুরুষদের জন্যে একটি দুঃসংবাদ’ আর দ্বিতীয় দিনেরটা ‘মেয়েদের জন্যে একটি আনন্দ সংবাদ।’ একটি বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে গৃহকর্তা একটি দৈনিক পত্রিকা পড়ছেন। সেখানে মেয়েদের জন্যে আলাদা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের বিজ্ঞাপনটি দেখে গৃহকর্তার চোখ ছানাবড়া এবং মাথার চুলগুলো সব খাড়া হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় জিজ্ঞাপনেও সেম ব্যাকগ্রাউন্ড। একই বাড়ির একটি ড্রয়িং রুমের একই চেয়ারে বসে গৃহকর্তী একটি দৈনিক পত্রিকা পড়ছেন এবং মেয়েদের জন্যে আলাদা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘মনোরমা’ প্রকাশের বিজ্ঞাপনটি দেখে আনন্দে তার তা তা থৈ থৈ অবস্থা। আইডিয়াটা এ্যাপ্রিসিয়েট করে এনায়েত ভাই কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝটপট এঁকে ফেললেন দুটি চমৎকার কার্টুন। আমার হাতে কার্টুন দুটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন—
—চিত্রালীর কাগজ চিত্রালীর কলম আর চিত্রালীর কালিতে মনোরমার বিজ্ঞাপন। যাও এইবার ভাগো। আমার চাকরিটা দয়া করে রক্ষা করো।
—থ্যাংক্ ওস্তাদ বলে আমিও গা ছাড়া ভাব নিয়ে অলস ভঙ্গিতে থাকা ঘোস্ট এডিটর সহসা এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে আসার ট্রেন বুঝি এক্ষুনি ছেড়ে দিচ্ছে। কাগজ দুটো বগলদাবা করে দিলাম এক দৌড়।
তিন
‘পুরুষদের জন্যে একটি দুঃসংবাদ’ শীর্ষক বিজ্ঞাপনটি ছাপা হবার পর মিজান ভাই আমাকে ডেকে পাঠালেন তার কক্ষে। তখন দুপুর। সকাল থেকেই নাকি বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন পাচ্ছেন তিনি। বিজ্ঞাপনটি সবারই পছন্দ হয়েছে। সবার নাকি ধারণা এটা তারই আইডিয়া। কিন্তু তিনি নাকি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন আইডিয়াটা মোটেও তার নয়। আইডিয়া পত্রিকাটির ঘোস্ট এডিটরের। ‘তুমি চালিয়ে যাও, তোমাকে দিয়েই হবে’ গোছের প্রাণিত উচ্চারণে তিনি আমাকে আপ্যায়ন করলেন বিশাল কাপভর্তি ধোঁয়া ওঠা গরম চা।
আমি নিরবে ধুমায়িত চা পান করছি আর মিজান ভাই মিটিমিটি হাসছেন। লাজুক লাজুক মিষ্টি মিষ্টি হাসি—সো নাইস। ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট।
—কার্টুনটা চমৎকার না মিজান ভাই?
—দারুণ। এ্যাক্সেলেন্ট।
—এই হচ্ছে সৈয়দ এনায়েত হোসেন। হামিদুল ইসলাম কিংবা মামুনুর রশীদের কাছ থেকে আমি এটা পাবো না।
—এ্যাগজাক্টলি। তুমি তাকে জয়েন করতে বলো।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম—জয়েন করতে বলবো? কাকে?
—এনায়েত সাহেবকে।
—না মিজান ভাই। অবজারভার ভবন ছেড়ে তিনি এখানে আসবেন না।
—তাকে বলো ভালো স্যালারি দেব।
—কিন্তু প্রায় তিরিশ বছরের চাকরি ছেড়ে তিনি মনে হয় না রাজি হবেন না।
—তাকে বলো বেনিফিট দেব। আমি খুশি হব।
ইতোমধ্যে খবর ভবনে কাজ করতে এসে আমার জানা হয়ে গেছে মিজান ভাইয়ের ‘আমি খুশি হব’ বলার মানে হচ্ছে এই বিষয়ে তিনি আর কোনো সংলাপে আগ্রহী নন। সুতরাং আপাতত সৈয়দ এনায়েত এবং তার যোগদান বিষয়ক আলোচনার এখানেই সমাপ্তি।
চার
খবর গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স-এর আরো একটি প্রকাশনা সংস্থা আছে নাম ‘নভেল হাউস’। এখান থেকে বই প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ বইয়ের লেখকই মিজানুর রহমান মিজান। এই সংস্থার দু’টো বই খুবই পাঠকপ্রিয়। একটি ‘আমি রাসেল বলছি’ অন্যটি সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ যেটা মাসুদুল হক অনুবাদ করেছেন ‘নিয়াজির আÍসর্ম্পণের দলিল’ নামে। মূলত মিজানুর রহমান মিজানের গ্রন্থ প্রকাশনার জন্যই সংস্থাটির আত্মপ্রকাশ। এর বাইরে অন্য যে কোনো বই প্রকাশের পেছনে হয় ব্যবসা বৃদ্ধি কিংবা অন্যকোনো উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে। এরকম আপাত লুক্কায়িত একটি উদ্দেশ্যমূলক গ্রন্থের নাম ‘রম্য-রমণীয়’। শেখ আকরাম আলীর রম্যরচনার সংকলন। আকরাম আলী একজন উচ্চ পদস্থ আমলা। সেই সময় তিনি ছিলেন যুগ্ম সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় ছিলনা। এক দুপুরে মিজান ভাই আমাকে তলব করলেন। জরুরি তলব। তার কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখি হাসিখুশি একজন লোক বসা। সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির হাল্লার রাজা সন্তোষ দত্তের মতো চেহারা। সদা হাস্যময়। মিজান ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সঙ্গে।
—তুমি কি আকরাম ভাইকে চেন?
—আলাপ নেই তবে তাকে আমি শহীদুল হক খানের টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দেখেছি। রসের গল্প নামের একটা আইটেমে দর্শকদের রস সরবরাহ করেন। আমার কথায় ভদ্রলোক খুশিতে বাকুম বাকুম হয়ে উঠলেন।
—দেখেছেন মিজান সাহেব হেহ্ হেহ্ হেহ্। সবাই আমাকে চিনে ফেলে। রাস্তাঘাটে চলাই যায় না। শহীদুল হক খান বলেছেন অনুষ্ঠানে আমার আইটেমটাই লোকে খায় বেশি।
অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করলাম। কারণ আমি তো জানি এই লোক রসের গল্প বলে নিজেই হেসে কুটিকুটি হন কিন্তু দর্শক মোটেই হাসে না। বরং বিরক্ত হয় তারা। শহীদুল হক খান এই লোককে দিয়ে ক্যানো যে একটা রেগুলার আইটেম করান সেটা খুবই রহস্যজনক। টিভির লোকেরা বলে এর পেছনে নাকি খান সাহেবের কোনো একটা মহান উদ্দেশ্য কাজ করছে। উদ্দেশ্যটা আমার কাছে এ্যাদ্দিন পরিষ্কার ছিল না। আজ কিছুটা পরিষ্কার হলো মিজান ভাইয়ের কথায়। আমার নির্লিপ্ততা কাটাতে মিজান ভাই বললেন
—তুমি হয়তো জানো না রিটন আকরাম সাহেব কিন্তু জয়েন্ট সেক্রেটারি অব হোম মিনিস্ট্রি।
—ও তাই নাকি! আপনি জয়েন্ট সেক্রেটারি? তাও আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের?
কথাটা এমনভাবে বললাম যেন হোম মিনিস্ট্রির জয়েন্ট সেক্রেটারি হওয়াটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। খুবই রেয়ার একটা ঘটনা। খুবই বিরল একটা ঘটনা।
আমার কথার নিগুঢ়তত্ত্ব অনুধাবন করতে না পেরে ভদ্রলোক হাসছেন হেহ্ হেহ্ হেহ্...। মিজান ভাইও হাসছেন হেহ্ হেহ্ হেহ্। মিনিস্ট্রি অব হোমের বিরল জয়েন্ট সেক্রেটারিকে চাক্ষুষ করে অতঃপর আমিও কোরাসে অংশ নিলাম—হেহ্ হেহ্ হেহ্...।
হেহ্ হেহ্ হেহ্... পর্ব শেষ হলে পর মিজান ভাই বললেন আসল কথাটি। আমাকে এইখানে ডাকার হেতুটা পরিষ্কার হলো।
—আকরাম ভাই ইজ সো নাইস।
—আই হ্যাভ নো ডাউট দ্যাট হি’জ আ নাইস পারসন। অ্যাজ লাইক অ্যাজ হাল্লা রাজা।
—হাল্লা রাজা? মানে? মিজান ভাই সন্দিহান। আমি কোনো ইয়ার্কি করছি কিনা সেটা তিনি নিশ্চিত নন। নিশ্চিত নন আকরাম আলীও। আমাকে তাই ব্যাখ্যা দিতে হলো।
—সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে হাল্লার রাজা এবং শুণ্ডির রাজার দ্বৈত ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। তার চেহারা এবং হাসিখুশি ভাবটি শেখ আকরাম আলীর সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম হি’জ এ্যাজ লাইক অ্যাজ হাল্লা রাজা। অ্যাজ লাইক অ্যাজ শুণ্ডি রাজা। আমি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে তাঁর চেহারার সাদৃশ্যের কথাটা বললাম। অতঃপর শেখ আকরাম আলী হেসে উঠলেন হেহ্ হেহ্ হেহ্। মিজান ভাইও যুক্ত হলেন হেহ্ হেহ্ হেহ্। আমি আর বাদ থাকি কেন? আমিও তথাস্তু—হেহ্ হেহ্ হেহ্ ...।
পাঁচ
মাসখানেক হলো কঠিন জন্ডিসের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। তো বাঙালি জন্ডিস থেকে সেরে উঠে যা যা করে আমিও ঠিক তাই তাই করছি। হোটেল-রেস্টুরেন্টে ঢুকি না। বাইরের কোনো খাবারই খাই না। পানিবাহিত রোগ জন্ডিস সুতরাং নিজ ঘরে ফুটানো পানি ছাড়া পানি পান তো রীতিমতো হারাম। ৮৮-৮৯ সালে ঢাকায় বসে মিনারেল ওয়াটার কিনে পান করার মতো বিলাসিতা মধ্যবিত্তের জন্যে মানানসই নয়। ফুটানো পানি ছাড়া মিনারেল ফুটানির সুযোগ কোথায় মধ্যবিত্তের? সুতরাং এলাহী ভরসার মতো স্বগৃহে ফুটানো পানির বোতলই ভরসা। কাধে ঝোলানো ব্যাগের ভেতর গৃহে নির্মিত জীবাণুমুক্ত তেলমসলাবিহীন মেডিক্যাল খাদ্য। কাঁচা কলা আর কাঁচা পেপের অবধারিত আইটেম। মাছ বলতে একটাই—শিং। কাঁচকলা আর কাঁচা পেপের সঙ্গে প্রতিদিন বিরামহীন শিং খেতে খেতে মাথায় শিং গজিয়ে যাওয়ার উপক্রম! শিং ছাড়া আর কোনো মৎস্য জগৎ সংসারে আছে কীনা প্রায় ভুলতে বসেছি। ভাত কিংবা হাতে গড়া রুটি, দুটির সঙ্গেই জুটি—শিং কাঁচকলা আর পেপের। পেপের বিষয়টি চেপে রাখার উপায় নেই। কলার বিষয়টি না বলার কোনো কারণ নেই। সুতরাং অফিসশুদ্ধ লোক জানে রিটন নামক উড়নচণ্ডি মানুষটি এখন খুবই বেকায়দায় আছে। হাতি গর্তে পড়লে নাকি চামচিকে এসে লাথি মারে। কিন্তু চামচিকে খাদে পড়লে হাতি এসে কি করে সেটা বুঝতে পারলাম আমি—সদ্য জন্ডিস ফেরৎ গোস্ট এডিটর। দাওয়াতের মচ্ছব পড়ে গেলো গুনে গুনে ঠিক সেই সময়টায় যখন ভোজন রসিক আমি ওজন মেপে খাই। যখন বাইরে যাওয়া বারণ, জন্ডিস যার কারণ। যখন দাওয়াত কবুল মানা, নিষেধ পান ও খানা। ধরে ধরে ঠিক এই সময়টায় সমাজের নানা অঙ্গনের হস্তিসদৃশ মানুষগুলো ইনভাইটেশন কার্ড নিয়ে হাজির। ভাই পরশু সন্ধ্যায় ঢাকা ক্লাবে। ভাই মনে আছে তো, মহরত? নারায়ণগঞ্জের মেরী এন্ডারসনে! শেরাটনে শুক্কুরবারে লাঞ্চের কথাটা ভুলবেন না যেন! সোনার গাঁয়ে ডিনার থ্রো করেছি আপনাদের সম্মানে। আসবেন কিন্তু উইথ ভাবী! না, না, রিপোর্টার আর ফটোগ্রাফার পাঠালেই হবে না বলে দিলাম! আপনাকে দেখতে চাই! সস্ত্রীক! এই রকম পরিস্থিতির কথা কল্পনা করেই হয়তো বা সেলিম আল দীন নাটক লিখেছেন—‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন!’ আমার জন্ডিস আক্রান্তের খবরেই বুঝিবা খাদ্যের বিবিধ বেলুনসমূহ আমার নাকের ডগার সামনেই এসে ফুলতে ফুলতে দুলতে দুলতে রঙিন পেখম খুলতে খুলতে দারুণ ছন্দ তুলতে তুলতে শেষমেশ নিছক একটা আমন্ত্রণপত্র বা ইনভাইটেশন কার্ড-এ রূপান্তরিত হয়ে না খোলা অবস্থায় অলস ভঙ্গিতে আমার টেবিলের ওপর পড়ে থাকে। আমার অধীনস্ত ফটোগ্রাফার রিপোর্টাররা কতো কি খায়! আর আমার কপালে শুধুই শিং মাছ আর কাঁচকলা!
বিপদে পড়লে মানুষ চোখে সর্ষেফুল দেখে। এই রকম ঘোরতর বিপদের সময় আমি চোখে দেখি শুধু কাচ্চি বিরিয়ানী! নেহারী আর নান রুটি! পরোটা আর খাসির পায়া! মোরগ পোলাও! তেহারী! গরুর ভুনা! চিকেন টিককা! রেজালা।—মহাজ্বালা! খেতে না পারার শোকে আমি মুহ্যমান। প্রভু, রক্ষা করো প্রভু। রক্ষা পাই না তবু। আমার এখন ছকে বাঁধা জীবন। ছকের বাইরে মরণ। খেতে না পেয়ে পৃথিবীতে বহু লোক মারা যায়। আর আমি কী না মরবো খাওয়ার অপরাধে? কোনটা শ্রেয়? না খেয়ে মরা নাকি খেয়ে মরা? দ্বিতীয়টার দিকেই আমার প্রবল ঝোঁক আমি উপলব্ধি করছি যখন, তখনই এক দুপুরে খবর ভবনে আগমন ঘটলো হাল্লা রাজা মানে শেখ আকরাম আলীর। মিজান ভাইয়ের কক্ষ থেকে হেহ্ হেহ্ হেহ্ পর্ব শেষ করে আমি চলে এসেছি নিচতলায় আমার কক্ষে। ঝোলার ভেতর থেকে ঝটপট হট-পট বের করে আমি আমার টেবিলের ওপর নিউজপ্রিন্ট বিছিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সমাপ্ত করছি। মেনুতে সেই ভয়াবহ খাদ্য যা পৃথিবীতে কেবলমাত্র জন্ডিস আক্রান্তদের জন্যেই চক্রান্ত করে সরবরাহ করা হয়েছে। মাত্র শেষ করেছি আহার, অমনি হাল্লা রাজার হাসির বাহার—
—বাহ্ তুমি তো দেখছি নিপাট ভদ্রলোক হে। বাড়ি থেকে খাবার এনে খাও। মিজান সাহেবের রুম থেকে যাবার সময় ভাবলাম তোমার কক্ষটা একবার দেখে যাই। তাছাড়া তোমাকে তো উনি বলেই দিয়েছেন এনায়েত সাহেবকে দিয়ে আমার রম্য-রমণীয় বইটির প্রচ্ছদটা করিয়ে দিতে।
‘জি জি বসুন বসুন’ বলে আমি হাতমুখ ধুয়ে পাক-সাফ হয়ে এলাম। ইতোমধ্যে আমার টেবিলটাকে ডায়নিং টেবিল থেকে সম্পাদকের টেবিলে রূপান্তরিত করেছে মনোরমার কিশোর পিওন আলমগীর। শুধু বোতলটি ছাড়া টেবিলে খাদ্য সংশ্লিষ্ট অন্য কিছুর আভাসমাত্র নেই।
মহাশক্তিধর আমলা যুগ্ম-সচিব স্বরাষ্ট্র-এর সঙ্গে আমি পিওন আলমগীরের পরিচয় করিয়ে দিলাম—ইনি একজন খুবই বড় মাপের মানুষ। এই স্যারের সাংঘাতিক ক্ষমতা বুঝলি আলমগীর?
—জে ছার! (আলমগীরের বিনম্র উচ্চারণ, সে বুঝতে পেরেছে!)
—এই স্যার হচ্ছেন বাংলাদেশের পুলিশদের স্যার!
—জে ছার! (আলমগীর সম্ভবত বিস্মিত—পুলিশরাতো নিজেরাই স্যার। এই স্যার তাহলে স্যারদেরও স্যার!)
—তোর কোনো আত্মীয়-স্বজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে, থানায় আটকে রাখলে, এই স্যার একটা ফোন করা মাত্র সেই লোকটা ছাড়া পেয়ে যাবে। বুঝলি?
—জে ছার। (ব্যাটা যে বুঝেছে সেটা ওর কাঁপা কাঁপা পদযুগল আর কণ্ঠস্বরই স্বাক্ষ দিচ্ছে!)
—তোর যদি কাউকে এ্যারেস্ট করাতে হয় তাহলে এই স্যারকে বললেই এই স্যার একটা ফোন করা মাত্রই লোকটা এ্যারেস্টেড হয়ে যাবে, বুঝলি?
—জে ছার! (এইবার আলমগীর ঘাবড়ে গিয়ে স্যালুট ঠোকার ভঙ্গিতে দীর্ঘ লয়ের একটা সালাম দিল শেখ আকরাম আলীকে) আচ্ছালা-য়া-য়া-য়া-য়া-মু- আলাইকুম ছার ...!
আমার ধারণা ছিল একজন পিওনের সঙ্গে তাঁকে আমার উপস্থাপন পদ্ধতিতে তিনি হয়তো বিরক্ত হবেন কিংবা হয়তো রেগেই যাবেন। এই ধরনের ক্ষমতাবান লোককে রাগিয়ে দেয়ার মজাটাই আলাদা। কিন্তু ভদ্রলোক রেখে না গিয়ে ব্যাপারটা খুবই এনজয় করলেন। বললেন—
—হেহ্ হেহ্ হেহ্ বেচারাকে আর ঘাবড়ে দিও না।
‘যা স্যারের জন্য স্পেশাল চা নিয়ে আয়’ বলে আমি আলমগীরকে একটা দশ টাকার নোট দিলাম। কিন্তু ছেলেটা এতোটাই ঘাবড়ে গিয়েছে যে ‘আনতিছি ছার’বলে টাকা না নিয়েই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। ত্রস্ত ভঙ্গিতে আলমগীরের প্রস্থানের দৃশ্য অবলোকন করে আকরাম ভাই হেসে উঠলেন হেহ্ হেহ্ হেহ্। আকরাম ভাইয়ের কথানুযায়ী আমাকে ফোন করতে হলো চিত্রালীতে। প্রিয় শিল্পী সৈয়দ এনায়েত হোসেনকে বুঝিয়ে বলতে হলো রম্য-রমণীয় বিষয়ক প্রচ্ছদ অংকনের বিষয়টি। এবারও বললাম এনায়েত ভাইকে—‘চাকরিটা রক্ষা করেন ওস্তাদ। কভারটা এঁকে না দিলে যে শুধু চাকরি খোয়া যাবে তা-ই নয়, আমাকে স্ট্রেইট জেলখানায় স্থানান্তরিত করা হবে।’ শুনে এনায়েত ভাইয়ের আনন্দ আর দেখে কে! —‘এ্যদ্দিনে তোমার একটা হিল্লে হবার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। তোমার জন্যে ওঠাইতো সঠিক জায়গা! অনেক জ্বালাইছো। এইবার বাগে পাইছি। রম্য-রমণীয় টমনীয় কোনো কভার আমি করতে পারবো না। শুভ হোক তোমার জেলখানা গমন’—বলে এনায়েত ভাই ফোন রেখে দিলেন।
আকরাম ভাইকে বললাম—নো প্রবলেম। আপনার বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি করে দেবেন।
—কি বললেন এনায়েত সাহেব?
—বললেন আপনাকে তিনি দেখেছেন টিভিতে। আপনার বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকাটা তার জন্যে রীতিমতো আনন্দের ব্যাপার। (বানিয়ে বানিয়ে বললাম!)
—তো তুমি একটা কাজ করো না কেনো?
—কি কাজ আকরাম ভাই?
—এনায়েত সাহেব যে কভারটা আঁকবেন, সাবজেক্ট-ম্যাটার নিয়ে তো তাকে একটা ব্রিফ করা দরকার। তাই না? নইলে তিনি আঁকবেন কেমন করে?
—হ্যাঁ, একটা ব্রিফিং তো অবশ্যই লাগবে। আপনাকে তাঁর ফোন নাম্বার দিচ্ছি, আপনি না হয় সময় সুযোগ মতো টেলিফোনে তাঁকে ব্রিফ করে দেবেন।
—ন্ নানানা। টেলিফোনে হবে না। সামনা সামনি হলে ব্যাপারটা মজবুত হয়।
—তাহলে আপনিই বলে দিন আমি এখন কি করতে পারি?
—তুমি বরং এক কাজ করো। এনায়েত সাহেবকে আবার টেলিফোন লাগাও। তাকে বলো আগামীকাল দুপুরে আমরা তার অফিসে আসছি। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো।
—আমরা মানে?
—আমরা মানে তুমি আর আমি। তারপর তিনজন ভালো একটা রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চটা সেরে নেবো। কভারের বিয়ষটিও ফয়সালা হয়ে যাবে।
—না আকরাম ভাই সরি। আমার বাইরে লাঞ্চ করার কোনো চান্স নেই। আপনারা দু’জন বরং...
—না না না। তুমি একদম না করতে পারবে না। আমি ঠিক একটায় এসে তোমাকে আমার গাড়িতে তুলে নেবো। তারপর চিত্রালী গিয়ে এনায়েত সাহেবকে তুলবো। তারপর দামি একটা রেস্টুরেন্টে... বাই দ্যা ওয়ে, তোমার খিদে পায় কখন? একটার সময় হলে অসুবিধে নেই তো?
না খেতে খেতে খাদ্যশোকে মুহ্যমান একজনকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তোমার খিদে পায় কখন! না খেতে পারার বেদনায় আমি চোখে সর্ষেফুল দেখা পর্যন্ত ভুলে গেছি আর সেই আমাকেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে খিদে পায় কখন! বললাম
—আমার তো সারাক্ষণই খিদে পায়।
—মানে? আকরাম ভাইর ভ্রুকুঞ্চিত প্রশ্ন।
—যতক্ষণ জেগে থাকি ততক্ষণই খিদে পায়। কেবল ঘুমিয়ে পড়লেই খিদেটা পায় না। আকরাম ভাই আমি একটা মহা বুভুক্ষ। আয়েম দ্যা সিম্বল অব তৃতীয় বিশ্ব।
রসিকতা মনে করে আকরাম ভাই হেসে উঠলেন—হেহ্ হেহ্ হেহ্।
তাকে থামিয়ে দিলাম আমি—
—হাসির কথা নয় আকরাম ভাই। সিরিয়াসলি বলছি। প্রিয় খাবারগুলো না খেতে পেয়ে শরীর আমার দুর্বল হয়ে পড়েছে। হাঁটা-চলা সব এখন সীমিত। সীমাবদ্ধ জলে আর সীমিত সবুজে আমার বসবাস। প্রিয় গান এখন একটাই—আমার এ দেহখানি তুলে ধরো...।
—হেঁয়ালী ছেড়ে আসল কথাটা বলে ফেলো তো! আকরাম ভাই খানিকটা বিরক্ত।
আমি অতঃপর আমার জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন কাহিনি তার কাছে বয়ান করলাম। বললাম, এটা দ্বিতীয় আক্রমণ জন্ডিসের। ডাক্তার বলেছেন তৃতীয় আক্রমণে জন্ডিস আমাকে বর্ডারের ওপারে পাঠিয়ে দেবে। এইযে দেখুন বাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে আসি। কাঁচকলা পেপে সেদ্ধ আর শিং মাছ নিয়ে আসি। গরম এবং ফুটন্ত বলে শুধু চা পান করার পারমিশনটা চিকিৎসকের কাছ থেকে আদায় করেছি বহু কষ্টে।
আমার মরণকাহিনি শুনেও যুগ্ম সচিব স্বরাষ্ট্র বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করলেন না। ব্যাপারটাকে অনেকটা মাছি তাড়ানোর মতো উড়িয়ে দিয়ে বললেন।
—ইয়াং ম্যান কিচ্ছু হবে না তোমার। এমন হোটেলেই খাবো আমরা যেখানে জন্ডিসের বাবারও ঢোকার সাধ্য নেই।
—না আকরাম ভাই।
আমি না বলছি বটে কিন্তু মস্তিষ্ক আমার পেটের ভেতরে তান্ডব নৃত্যের আয়োজন করে বস আছে! মুখে আমি একবার না বলছি ঠিকই কিন্তু আমার ভেতর থেকে একশোবার হ্যাঁ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রথমে মস্তিষ্কে, তারপর পেটের গভীর গহন অন্তহীন অন্ধকারে। প্রতিধ্বনি—কাচ্চি কাচ্চি কাচ্চি। প্রতিধ্বনি—খিরি কাবাব গুর্দা কাবাব। গুর্দা কাবাবকে মুর্দাবাদ বলার শারীরিক ও মানসিক দুটো শক্তিই আমি হারিয়ে বসে আছি। আমার নাম এখনই এফিডেভিট করে পাল্টে ফেলা দরকার। নোটারি পাবলিক ভাইয়া আমার নাম ইথিওপিয়া। পিতার নাম তৃতীয় বিশ্ব। মাতার নাম ...।
আলমগীর পরিবেশিত চা’য়ে শেষ চুমুক দিতে দিতে আকরাম ভাই শেষ বারের মতো আমাকে লাইনে আনার চেষ্টা করলেন—
—শোনো হে জন্ডিস, শেখ আকরাম আলী এভাবে কাউকে রিকোয়েস্ট ও করে না আর রিকোয়েস্ট করলে কেউ তোমার মতো এরকম ডিনাই ও করে না। আমি তোমার বড় ভাই তূল্য। শত্রু তো নই! একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না।
—‘রাজী হয়া যান ছার’। (আলমগীরের মিনমিনে উচ্চারণ) ‘একদিন খালি পরে কিছু হবে না ছার।”
আলমগীরের কণ্ঠে কাতর মিনতি ঝরে পড়ছে। আমার বুঝতে বাকি থাকে না যে ব্যাটা খুবই ভয় পাচ্ছে। পুলিশরা যাকে স্যার বলে সেইরকম ‘স্যারদের স্যার’ একজনের আমি কী না অবাধ্য হচ্ছি! এই লোক তো তার (আলমগীরের) প্রিয় ছারকে এখুনি পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারে। পুলিশের ঠ্যাঙানির চেয়ে জন্ডিস আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে অনুরোধ বা নির্দেশ মোতাবেক খানাখাদ্য খেয়ে নেয়াই বরং উত্তম। আর তাই অপেক্ষাকৃত উত্তম প্রস্তাবটির প্রতিটিই তার মিনমিনে সমর্থন। তাছাড়া আমার মস্তিষ্ক এবং পাকস্থলীও ইতোমধ্যে আলমগীরের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বসে আছে!
—ঠিক আছে আকরাম ভাই আপনার নির্দেশ শিরোধার্য।
আমার সম্মতি পেয়ে আকরাম ভাই রসিকতায় মেতে উঠলেন।
—আমি এতোক্ষণধরে বলছিলাম রাজি হচ্ছিলে না কিন্তু তোমার পিওনটা দেখি একবার বলাতেই তুমি রাজি হয়ে গেলে। ডাইরেক্ট ওকে ধরলেই তো কাজটা আরো দ্রুত সমাধা হয়ে যেত!
—জি আকরাম ভাই এই হারামজাদাটাকে আমি খুব মান্যিগন্যি করি। মিজান ভাইয়ের জেলার লোক। ফরিদপুর। মিজান ভাইয়ের সঙ্গে ডাইরেক্ট কানেকশন ওর। ওর কথার বাইরে গিয়ে শেষে চাকরিটা খোয়াবো নাকি?
আকরাম ভাই ঘর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠলেন আর লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার ভঙ্গিতে কক্ষ থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হলো পিওন আলমগীর।
ছয়
পরদিন অফিসে এলাম রিলাক্সড মুডে। আজ আমি মুক্ত স্বাধীন। বহুদিন পর শিংমাছ কাঁচকলা আর পেপেহীন জীবনের স্বাদ পেতে যাচ্ছি। মন খুশিতে টইটুম্বর। মন খুশিতে বাকুম বাকুম। শালার ব্যাটা জন্ডিস আজ তোকে দেখে নেবো। কতো ধানে কতো চাল। কতো গমে কতো আটা। কতো দুধে কতো মাঠা। কতো কাবাবে কতো হাড্ডি। হড্ডি হাড্ডি হাড্ডি। হাড্ডির সাথে কী মিল দিই? মিলছে না তো! না মিলুক। ক্ষতি নেই। মিলের দরকার নেই। মিলের খ্যাতাপুরি। আজকে আমি সব খাবো। আজকে আমি সেলিম আলদীনের ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি।’ কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা—মনে মনে লিস্টি করি প্রিয় প্রিয় সব খানা ...।
সকাল এগারোটার পর মিনিটে মিনিটে ঘড়ি দেখি একটা বাজতে আর কতো বাকি। পিওন আলমগীর খুবই উল্লসিত। বহুদিন পর তার ‘ছার’ আজ খানা খাবে। বাইরের খানা। ছার খুশি তাই সে-ও খুশি। সবচেয়ে খুশি ছারের ছেলেমানুষী দেখে। নিজের হাতে ঘড়ি আছে। দেয়ালে রয়েছে দেয়ালঘড়ি। অথচ ছার তাকে বারবার জিজ্ঞেস করছেন—
—অই ব্যাটা আলমগীর, যা ব্যাটা দেখে আয় তো কয়টা বাজে?
—ছার এগারোটা পঁচিশ মিনিট।
—মাত্র এগারোটা পঁচিশ! একটা বাজতে কয়টা বাকি?
—ছার দেড় ঘণ্টা।
—চোপ ব্যাপা দেড় ঘণ্টা! তুই কি করে জানলি যে দেড় ঘণ্টা?
—ছার অইযে ঘড়ি দেওয়াল ঘড়ি।
—এইটা স্লো হয়ে গেছে মনে হয়। যা ব্যাটা খবরের নিউজ রুমের ঘড়িটা দেখে আয় ওটা পারফেক্ট টাইম দেয়। একদৌড়ে নিউজ রুম ঘুরে এসে বিজয়ীর হাসি আলমগীরের—
—কইছেলাম না ছার? এগারোটা ছাব্বিশ বাজে!
—দেখলি, বলেছিলাম না আমাদের ঘড়িটা স্লো যাচ্ছে আজ! বাজে এগারোটা ছাব্বিশ আর ইনি বসে আছেন পঁচিশে ...।
—না ছার এহন আমাদের ঘড়িতেও এগারোটা ছাব্বিশই ছার।
—হারামজাদা আবার দেখি তর্ক করে? যা ব্যাটা তোর চাকরি নট্। গো ব্যাক টু ফরিদপুর, গো।
আলমগীর হাসে হিহ্ হিহ্ হিহ্ হিহ্। যেনো আমি একটা হাসির কথা বলেছি। চাকরি নট্-এর ঘোষণা কি হাসির কোনো বিষয়? অন্য দিন হলে আলমগীর ঘাবড়ে যেতো। কিন্তু আজ ওর ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই কারণ তার ছার আজ ‘দিলখোস’ অবস্থায় আছেন। এমন দিনে আর যাই হোক কেউ কারো চাকরি নট্ করতে পারে না।
—আলমগীর?
—জে ছার।
—শোন্, আমাদের ঘড়িগুলো সব কমদামি। মেড ইন চায়না অথবা মেড ইন তাইওয়ান। এইজন্য ঠিক টাইম দিচ্ছেনা বোধ হয়। তুই একটা কাজ কর বাবা। মিজানুর রহমান মিজান সাহেবের রুমে গিয়ে টাইমটা একটু চেক করে আয় যা।
‘জে ছার’ বলে আমলগীর আমার কক্ষ থেকে বেরোয় ঠিকই কিন্তু সরাসরি ওপরতলায় যায় না সে। আমি জানলার কাচে শার্লক হোমস্ মার্কা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে খবর হাউজের সদর দরোজায় দাঁড়িয়ে আরো তিন চারজন পিওনের সঙ্গে আলমগীরের গালগল্পের রিফ্লেকশন দেখি! শিওর ব্যাটা আমার কাণ্ড-কারখানার ফিরিস্তি তুলে ধরছে ওর কলিগদের সঙ্গে। এই ভবনের ‘ছারদের’ নিয়ে আলোচনা করাটা ওদের প্রধানতম বিনোদন। আজ ওদের বিনোদনের আইটেমে নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে ‘ঘড়ি’। ঘড়িতে দ্রুত একটা না বাজলে ওর ছারের যে বারোটা বেজে যাচ্ছে সেটা রঙ্গরস সহযোগে বয়ান করে আলমগীর আজ প্রধান বক্তার শিরোপা অর্জন করেছে। পিওনদের এসোসিয়েশনে মনোরমার পিওনের এই সম্মান প্রাপ্তিতে আমিও কিছুটা গৌরব বোধ করলাম। কারণ পিওনদের মধ্যে এই সম্মানের প্রায় নিয়মিত প্রাপকের ভূমিকায় থাকে মিজান ভাইয়ের ব্যক্তিগত পিওনটি। কারণ ছারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাস্যকর কাণ্ড করেন ‘বড়ছার’ অর্থাৎ মিজানুর রহমান মিজান। আলমগীরের গর্ব, আজ তার ছার অর্থাৎ ‘রিটন ছার’ সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন!
রজমান মাসে ইফতারের আগে আগে ঘড়িগুলো যেমন স্লো হয়ে পড়ে আজ অবস্থাটা অনেকটা সেরকম। দী-ই-ই-র্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে ঘড়ির কাঁটা বারোটা আটচল্লিশ ক্রস করল। অনেক সাধনায় সিদ্ধিলাভের আনন্দে লাফাতে লাফাতে হাস্যোজ্জ্বল আলমগীর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো—ছার একটা বাজতে এহনো বারো মিনিট দেরি কিন্তু ছারে আইস্যা পড়ছেন!
আলমগীরের প্রবল উৎসাহে পানি ঢালার ভঙ্গিতে কিছুই মনে নেই এমন ভাব করে বললাম।
—কোন স্যার?
—অইযে যার জইন্যে সকাল থেইকা ঘড়ি দ্যাখতিছেন ছার!
—কার জন্যে আমি ঘড়ি দ্যাখতিছি?
—অইযে পুলিশরাও যারে ছার কয় হেই ছার!
—পুলিশরা কারে ছার কয়?
বেদনার অকুল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে আলমগীর। আহারে তার ছারের একী হাল? ছারের মাথার বেবাক ইস্কুরু আইজ ঢিলা হইয়া গ্যাছে! আইজ ছারে খানা আনেন নাই ছারের সাথে বাইরে দাওয়াত খাবেন বইল্লা, অথচ এহন গেছেন সবকিছু ভুইল্যা? আলমগীর মর্মাহত। ও আশা করেছিল ‘ছারে বারো মিনিট আগে আইস্যা পড়ছেন’ এই খবর সরবরাহ করার পুরস্কার হিসেবে তার ছার খুশিতে তাকে বকশিস দেবেন। খুশিতে এমনকি ছুটিও দিয়ে দিতে পারেন আজ। বড়লোকদের ব্যাপার-স্যাপার আলাদা। খেতে বসলে, ভালো লাগলে দুই তিন ঘণ্টা ধরে খায়। বাইরে খেতে গেলে সেদিন আর অফিসে ফেরেনই না। আলমগীররা জানে ওদের ছাররা লাঞ্চ কিংবা ডিনারে খেলে সঙ্গে কিঞ্চিৎ পাগলা পানিও খায়। পাগলা পানি খেয়ে ছারেরা অনেকেই আর অফিসে ফেরেন না। পাগলা পানি খেয়ে কোন্ কোন্ ছার পাগলা হয়ে পাগলামি করেন তার তালিকাও আলমগীরদের মুখস্থ। ‘মনোরমা ছার’ এই তালিকায় একেবারে নিচের দিকে, অর্থাৎ শেষ নামটি। প্রথম প্রথম এই কারণে আলমগীর খুব অপমানিত বোধ করতো তার পিওনদের এসোসিয়েশনে। কারণ প্রায় সব ছারের কোনো না কোনো পাগলামী আচরণের বিস্তারিত বর্ণনা পিওনদের মুখস্থ। ‘চিত্রবাংলা ছার’গোলাম কিবরিয়া ‘বর্তমান দিনকাল ছার’আমীরুল মোমেনিন কিংবা ‘ছায়াছন্দ ছার’হারুনুর রশীদ খান-এর পাগলাপানির কাহিনি তাদের পিওনরা বয়ান করে অহংকারের সঙ্গে। স্পর্ধিত কণ্ঠে ওদের গর্বিত উচ্চারণ শোনে আলমগীর আর অপেক্ষা করে সেই সুদিনের যেদিন তার ‘মনোরমা ছার’-এর কাহিনিও সে বয়ান করতে পারবে গভীর প্রত্যয় আর সীমাহীন আনন্দে। মনোরমা ছারের কারণে আলমগীরের মান সম্মান আর রইল না। পাগলা পানি খাবে কি, জন্ডিসের কারণে তার ছার পানিই খায় না অফিসে! বোতল নিয়ে আসে বাড়ি থেকে। ছায়াছন্দ ছার বর্তমান দিনকাল ছার এবং চিত্রবাংলা ছারদের গোপন ঝোলাতেও বোতল থাকে। তবে তাদের বোতলে রঙ্গিন পানি। কিন্তু মনোরমা ছারের বোতলের পানি সাদা। আর সে কারণেই পিওনদের এসোসিয়েশনে আলমগীরের প্রেস্টিজের চাকা রীতিমতো পাংচারড!
সাত
ঝকঝকে শাদা গাড়ি আকরাম ভাইয়ের। সরকারি গাড়ির সরকারি ড্রাইভারও কেতাদুরস্ত। ভাবভঙ্গিতে সেও একজন ছোটোখাটো আকরাম আলী। লক্ষ করেছি, ধন্যাঢ্য বদমেজাজী গৃহকর্তার বাড়ির কুকুরটির মেজাজও থাকে তুঙ্গে। দিনমান ঘেউ ঘেউ। ঘেউ ঘেউ। কারণ ছাড়াই। সারাক্ষণ ঘেউ ঘেউ গর্জনে কুকুরটিও জানান দেয়—তার মালিকটি একজন বিশিষ্ট রাগান্বিত ব্যক্তি। অতএব খবরদার—আমিও। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের গাড়ির ড্রাইভারদের আচরণেও তার মালিকের ছাপ থাকে। ছায়া থাকে। দাপুটে রাজনীতিবিদ মোস্তফা মহসীন মন্টুর গেস্ট হয়ে একবার ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ গিয়েছিলাম একটা স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমরা তিনজন—অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আর আমি। মন্টুভাই কেরানীগঞ্জেই ছিলেন। ঢাকা থেকে আমাদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল তার পাঠানো গাড়ি। গাড়িতে আমরা তিনজন আর মন্টুভাইয়ের ড্রাইভার। নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জ যেতে হয়। পুরোন ঢাকার চকবাজারের আশপাশে সম্ভবত সুয়ারী ঘাট কিংবা এইরকম কোনো একটা ঘাট—যেটা সদরঘাটের সঙ্গে রিলেটেড—পার হয়ে তবে যেতে হয় কেরানীগঞ্জ। ঢাকার ভয়াবহ ট্রাফিক-জ্যাম অতিক্রম করে আমাদের বহনকারী গাড়িটি ঘাট পর্যন্ত এলো বীরদর্পে। ড্রাইভারের গাড়ি চালানোর ভঙ্গি, তার আচরণ, পথের রিকশা, স্কুটার এবং অন্যান্য প্রাইভেট গাড়ির চালকদের সঙ্গে গালাগালসহযোগে তার কথোপকথন, সর্বোপরি ট্রাফিক পুলিশদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, জমিদারি স্টাইলে লাইনে সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে লাইন ভেঙ্গে সে এগিয়ে গেলো ফেরীঘাটে। তার গাড়িটি সবার আগে ফেরীতে চাপবে। দেখেশুনে সায়ীদ স্যার বলেছিলেন, ‘মন্টুর দাপট আমরা অনুমান করে নিতে পারি তার ড্রাইভারের আচরণ থেকেই। মন্টু গাড়িতে নেই তাতেই এই অবস্থা, মন্টু থাকলেতো ও মানুষদের রীতিমতো মারধর করতো... !
শেখ আকরাম আলীর ড্রাইভারও অনেকটা তেমনি। শান্তিনগর খবর ভবন থেকে মতিঝিল অবজারভার ভবনে আসতে আমাদের পাঁচ-ছয় মিনিট সময় লাগল। রওনা হবার আগে খুশি খুশি ভাব নিয়ে আলমগীর জিজ্ঞেস করেছিল—ছার ফিরা আসবেন কুন সময়?
—এখনতো একটা বাজে—খেতে খেতে গল্প-টল্প করে ফিরতে ফিরতে এই ধর গিয়ে মিনিমাম তিনটা তো বাজবেই। কেউ ফোন করলে বা আমার খোঁজে এলে বলবি তিনটার পর। ঠিকাছে? ‘জে ছার’ বলে এমন একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলো ছেলেটা যে আমার মনে হলো খাওয়ার নিমন্ত্রণটা আমার নয়, আলমগীরেরই! খাবো আমি খানা আর ব্যাটা খুশিতে আটখানা!
আজ দুপুরের খাওয়া বিষয়টি আমি এতোটাই সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম যে রাতে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য স্বপ্নও দেখা হয়ে গেছে। স্বপ্নে আমি বিশ্বাস করি না, ছহি খাবনামা ও ফালনামাও পড়ি না, তারপরেও কুসংস্কার এসে হানা দিয়েছে বারবার—স্বপ্নটা যেনো সত্যি না হয়। স্বপ্নটা আসলে স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্নের মাঝামাঝি। সেটা পরে বলছি। আগে বলি চিত্রালী আর সৈয়দ এনায়েত হোসেনের গল্প। চিত্রালীতে ঢুকেই হইচই শুরু করতে যাবো—দেখি এনায়েত ভাইয়ের চেয়ারটা ফাঁকা। বোধহয় টয়লেট কিংবা অন্য কোথাও গেছেন, এখুনি ফিরবেন ভেবে আমি আর আকরাম ভাই তার টেবিলের সামনে থাকা চেয়ার দুটোয় বসে পড়লাম। কারণ এনায়েত ভাই জানেন শার্প একটায় আকরাম ভাই আমাকে মনোরমা থেকে তুলে নেবেন। তারপর আমরা আসবো চিত্রালীকে এনায়েত ভাইকে তুলতে। অতঃপর হোটেল অভিমুখে যাত্রা এবং বিরামহীন আরামদায়ক চেয়ারে বসে কাউকে কেয়ার না করে ধারাবাহিক ভোজনপর্ব। কিন্তু এনায়েত ভাই নেই। কেনো নেই? জিজ্ঞেস করলাম এনায়েত ভাইয়ের সহকর্মী চলচ্চিত্র সাংবাদিক নরেশ ভুঁইয়াকে। নরেশ ভুঁইয়া একজন সজ্জন ব্যক্তি। সমস্যা একটাই—সবাইকে তুই করে বলেন। কবি শামসুল ইসলামের মতো। কবি শামসুল ইসলামও সবাইকে তুই করে বলেন। আরেকটা অদ্ভুত মিল দুজনার—ওরা দুজনই নোয়াখালীর অ্যাকসেন্টে কথা বলেন। নরেশ ভুঁইয়া বললেন—
—এনায়েত ভাইর লাই বই রইছতনি তোরা? হেঁতি তো আঁইতোনো।
—আঁইতোনো মানে? অবশ্যই আঁইতো! তারতো থাকার কথা আজ এই সময়টায়। কালকেইতো কথা বললাম!
এবার এগিয়ে এলেন চিত্রালীর ফটোগ্রাফার বেলাল। এইটাও নোয়াখাইল্যা এবং এইটা আরো ভয়াবহ। সিনেমার নায়ক নায়িকাদের পর্যন্ত তুই করে বলেন! কি এক অজানা কারণে জানি না আমাকে খানিকটা কনসিডার করেন। দয়া করে তুমি বলেন। বেলাল ভাই বললেন-
—শুনো মিয়া, এনায়েত ভাই আঁইতোনো এইডা পাইনাল। সেঁতির ফারিবারিক ফ্রবলেম হইগেছে। পোন করি জানাই দিছে। তুমি যদি বসি থাইকতে চাও থাইকতে ফারো। লাব নাই।
—এনায়েত ভাইকে একটা ফোন করা যাবে এখান থেকে?
—মিরপুর নতুন প্ল্যাটে উঠছে। বাড়িত্ পোন নাই।
এনায়েত ভাইর বাড়িতে ‘পোন’ নাই শুনে আমিতো হতাশায় এবং রাগে হাঁসফাঁস করতে থাকলাম। চিত্রালীতে ফোন করে জানাতে পারলেন আর আমাকে অফিসে একটা কল দিলেন না এনায়েত ভাই!
ইটস্ ওকে ইটস্ ওকে বলে আমাকে শান্ত করলেন আকরাম ভাই। আমরা নিচে নেমে এলাম। আকরাম ভাইর গাড়িতে উঠে বসলাম। মনের ভেতরটা খচখচ করতে লাগলো—এনায়েত ভাইকে নিয়ে খাওয়ার কথা অথচ এখন খেতে হবে তাকে ছাড়াই। নিশ্চয়ই বড় রকমের কোনো ঝামেলা হয়েছে। নইলে নিপাট ভদ্রলোক সৈয়দ এনায়েত হোসেনের পক্ষে এমন দায়িত্বহীন কাজ করা অসম্ভব ব্যাপার। কী হয়েছে তাঁর? কোনো খোঁজ-খবরও তো নিতে পারবো না। কারণ তার নতুন বাড়িতে তো ‘পোন’ নেই!
গাড়ি স্টার্ট নেবার আগে ড্রাইভার-স্বরাষ্ট্র জিজ্ঞেস করলো কোন দিকে যাবে সে। নামিদামি বিখ্যাত কোনো একটা রেস্টুরেন্টের নাম শোনার জন্য আমার কর্ণযুগল উৎকীর্ণ হয়ে আছে। হাল্লা রাজার যমজ খালাতো ভাই শেখ আকরাম আলী বললেন—সোজা অফিসে যাও। সেক্রেটারিয়েটে আমাকে নামিয়ে দিয়ে এই স্যারকে শান্তিনগরে নামিয়ে দেবে।
আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। বাকপটু আমি হঠাৎ যেনো বা বাকশক্তিরহিত কোনো প্রাণীতে পরিণত হলাম মুহূর্তেই। গাড়ি যখন সত্যি সত্যি সচিবালয়ে প্রবেশ করলো আমি তখন স্ট্যাচু অব লিবার্টি। নট নড়ন চড়ন অবস্থা। গাড়ি থেকে নামতে নামতে আকরাম আলী কী যে বললেন মাথামুণ্ডু কিছুই আমার মাথায় ঢুকলো না। শব্দহীন হয়ে পড়েছে আমার পৃথিবী। আমার কর্ণকুহুরে আকরাম আলী উচ্চারিত কোনো শব্দই প্রবেশ করলো না। আমি শুধু দেখলাম তার ঠোঁট দুটো নড়ছে। মুখ হাসিহাসি। তিনি হাত নাড়ছেন। যন্ত্রচালিতের মতো আমিও হাত নেড়েছি, বাই বাই দেখা হবে টাইপের হাত নাড়া। সচিবালয় থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ি চলে এলো শান্তিনগর খবর ভবনের মূল ফটকের সামনে। আমাকে নামতে না দেখে ড্রাইভার বোধ করি একটু বিস্মিত বোধ করছে। আমার নামা উচিত এটা বোঝানোর জন্য তিনি বললেন—স্যার কি অন্য কোনোখানে যাইবেন? আপনাকে নামায়ে দিয়ে আসবো?
এতোক্ষণে কথা বলার শক্তি ফিরে পেলাম আমি—
—না না, আর কতো নামাবেন আমাকে?
—জি স্যার?
—নামাতে তো আর কিছুই বাকি রাখলেন না।
—জি স্যার? আমাকে কিছু বললেন?
—আপনার স্যার তো দেখছি একটি সারমেয় শাবক।
—জি স্যার? কি মেয়?
—সারমেয়! সারমেয় শাবক। মানে বুঝেছেন?
—জিনা স্যার। গরিব মানুষ। লেখাপড়া বিশেষ করি নাই।
—সারমেয় মানে হচ্ছে কুকুর। আর শাবক মানে বাচ্চা। এবার বুঝেছেন? এবার ড্রাইভারের স্ট্যাচু হবার উপক্রম। অনেকটা তোতলানো উচ্চারণে বিস্ময় ঝরে পড়ে ড্রাইভারের কণ্ঠে—
—স্যার এইসব কী বলছেন? কী বলতেছেন স্যার!
—হ্যাঁ আপনার স্যারকে গাল দিচ্ছি। আপনি আপনার স্যারকে বলবেন যে আমি তাকে ‘সারমেয় শাবক’ বলেছি। কি, বলতে পারবেন না?
—পারবো ইনশায়াল্লাহ। কোনো পারবে না? বলতেছেন আপনি। আমিতো আর বলি নাই। কিন্তু স্যার গালিটা মনে থাকবে না স্যার। ভুইল্ল্যা যাবো। কঠিন গালি স্যার। একটা সহজ গালি দ্যান্ .... ।
—না এরচে সহজ গালি তার প্রাপ্য নয়। এই গালিটাই তাকে পৌঁছে দিতে হবে। ক্যানো জানেন?
—জিনা স্যার।
গাড়িতে বসেই পুরো ব্যাপারটা তাকে বললাম। সবিস্তারে। আমার জন্ডিস এবং জবরদস্তি খেতে নিয়ে যাওয়া এবং এনায়েত সাহেব নেই দেখে না খাইয়ে এভাবে আমাকে অফিস অব্দি পৌঁছে দেয়া এবং আমার বাড়ি থেকে গৃহেনির্মিত শিং কাঁচকলা পেপের হটপট সংগত কারণেই না আনা ইত্যাদি সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। অনেকটা নালিশের ভঙ্গিতে। সব শুনে মহাপরাক্রমশালী ড্রাইভার জিভ কাটলো খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে—
—আমার স্যার খুবই অন্যায্য কাম করছেন। লোকটা ভালোনা। আমি স্যার তার ডিউটিতে নতুন আসছি। আমাকে স্যার মাপ কইরা দ্যান বলে লোকটা সত্যি সত্যি হাত জোড় করলো।
—আপনি ক্যানো মাপ চাইছেন! সরি, আপনি যান। আপনারতো দোষ নেই। তবে গালিটা দয়া করে পৌঁছে দেবেন—বলতে বলতে আমি বেরুলাম গাড়ি থেকে।
ড্রাইভারের আসন থেকে নেমে পড়লো ড্রাইভার—
—কিন্তু স্যার আমার তো স্যার মনেই থাকবে না স্যার আপনের কঠিন গালিটা। কি যেনো স্যার—সারো...
—সারমেয় শাবক।
—একটু লেইখ্যা দিবেন স্যার?
‘ক্যানো নয়?’ বলে ব্যাক পকেট থেকে নিউজপ্রিন্টের প্যাড বের করে ইকনো বলপেন দিয়ে খসখস করে লিখলাম ‘সারমেয় শাবক।’ ‘সারমেয় শাবক’কে বুক পকেটে ভাঁজ করে রেখে দিলো লোকটা।
আট
দু’ঘণ্টার কথা বলে মিনিট কুড়ির মাথায় আমাকে মনোরমায় ফিরতে দেখে আলমগীর বিস্মিত।
—ছার কি কিছু ফেলায়ে গেছিলেন?
—নারে আলমগীর কিছু ‘ফেলায়ে’ যাইনি?
—গেলেন তো খাতি। অত জলদি খাওয়া শেষ?
—নারে ব্যাটা শেষ কি, খাওয়া তো শুরুই হয়নি এখানো। আমাকে খাওয়াবেন বলে আকরাম সাহেব নিয়ে গেলেন ঠিকই কিন্তু এনায়েত সাহেব নেই বলে আমাকে অভুক্ত অবস্থায় ‘ফেলায়ে’ গেছেন অফিসে। কি করি বলতো? খিদেয় তো আমার প্রাণ যায় যায়। বাড়ি থেকে খাবারও আনা হয়নি। বাইরের কিছু খাওয়াও তো সম্ভব নয়। চোখে অন্ধকার দেখছি রে আলমগীর। জন্ডিসের পেসেন্টদের খিদেটা মারাত্মকরে ব্যাটা।
—আপনার খুব কষ্ট হতিছে ছার?
—কষ্ট হতিছে মানে? ইচ্ছে তো করছে শান্তিনগর হোটেলে ঢুকে সবকিছু খেয়ে ফেলতে। কিন্তু জন্ডিস বলে কথা। এই হোটেলে খাওয়া মানেই ইন্নালিল্লাহ...।
—আমি নিয়া আসি? একদিন খালি পর কিছু হবে না ছার! যাই?
—নারে হারামজাদা, তুইতো দেখছি আমাকে মারার ফন্দি করছিস! ব্যাপার কিরে?
—না ছার। আপনে তো খিদা সইয্য করতি পারেন না।
—খিদে কেউ সহ্য করতে পারে না।
—পারে ছার। গরিব মানুষেরা পারে। গরিব হলি পর না খায়া থাকাটা ছার অব্ভাস্ হয়া যায়। আপনেরা বড়লোক। আপনারা না খায়া থাকার কষ্ট সইয্য করতে পারবেন না। গরিব হলি পারবেন।
—তুইতো দেখি শ্রেণিসংগ্রামের ফিলোসফি কপচাচ্ছিসরে ব্যাটা। কদ্দুর পড়াশুনা করেছিলি যেনো?
—আমি ছার এইট পাস।
—ওক্কে এইট পাস ফিলোসফার, আমাকে গরিব ধনী আর খিদের ব্যাপারে জ্ঞান না দিয়ে কয়েকটা লেখা এন্ট্রি করে দিচ্ছি—কম্পোজে দিয়ে তুই আজ বাড়ি চলে যা। আমি দ্রুত বাসায় গিয়ে এক্ষুনি ভাত না খেলে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই অফিসেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো। আজ আর হোণ্ডা চালিয়ে বাড়ি যাওয়ার শক্তিও নেই। যা জলদি একটা স্কুটার ডেকে নিয়ে আয়। ততোক্ষণে আমি লেখা এন্ট্রি করছি। যা ভাগ।
নির্দেশ পালন করতে দ্রুত বেরিয়ে গেল আলমগীর। এবং খুব শিগগিরই ফিরে এলো। ওর হাতে একটা ডাব আর চারটে কলা। শান্তিনগর মোড়ে কলা আর ডাব পাওয়া যায়। ডাবটা কাটিয়ে একটা স্ট্র লাগিয়ে এনেছে। আমিই সাধারণত নানান কাণ্ড করে ওকে চমকে দিই। ঘাবড়ে দিই। আজ আমাকেই চমকে দিলো, ঘাবড়ে দিলো আলমগীর। এমনিতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে খুব দৃঢ়কণ্ঠে কথা বলে না সে। কিন্তু আজ ওর কণ্ঠস্বরে আশ্চর্য রকমের দৃঢ়তা। এমনিতে আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলে না সে। কিন্তু আজ সে কথা বলছে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে।
—এহন লেখা এন্টি করা লাগবিনা ছাড়। আগে এই ডাবটা আর কলাগুলান খান।
এন্ট্রি খাতা থেকে চোখ তুলে বিস্মিত আমি নিজের বিস্ময়কে কঠোরভাবে চেপে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলি
—তোকে তো আমি কলা আর ডাব আনতে বলিনি আলমগীর? তোকে তো আমি স্কুটার ডাকতে বলেছিলাম!
—ইসকুটার পরে ডাকবো। আগে খায়া ন্যান্। আপনি খিদা সইয্য করতে পারেন না। আপনের জন্ডিস হইছে। না খালি পরে আপনি তো ছার অজ্ঞান হয়া যাবেন।
—তোকে তো আমি টাকাও দিইনি!
—টাকা লাগবি না ছার! আগে খায়া ন্যান।
আলমগীরের কণ্ঠে একটা অদ্ভুত মমতা মাখানো নির্দেশ। খিদেয় সত্যি সত্যি দুলে উঠেছে আমার পৃথিবী। আমার চোখের ফ্রেমে কলা আর ডাব হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আলমগীর একবার ডানে আবার বামে হেলে পড়ছে।
অফিসে কিশোর পিওন আলমগীরের সঙ্গে যতোই হম্বিতম্বি করি না কেনো ওর জন্যে আমার কিঞ্চিত মমতাও আছে এটা আমি জানতাম। কিন্তু আমার জন্যে ওর হৃদয়ে ‘সামান্য জায়গা’ আছে কিনা সে খবর কখনো জানা হয়নি। একটু আগে বড়মাপের মানুষ শেখ আকরাম আলী, যুগ্মসচিব স্বরাষ্ট্র শেখ আকরাম আলী আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তা এক কথায় অমানবিক। কল্পনীয়। অরুচিকর এবং অশালীনও। আমলা শেখ আকরাম আলীর সবই আছে—বাড়ি গাড়ি টাকা স্ট্যাটাস উচ্চপদ, শিক্ষা, সব সবকিছু। সবকিছু অঢেল থাকার পরও লোকটা দীনহীন। লোকটার আত্মা নেই। অথচ নিতান্ত দীনহীন কিশোর পিওন আলমগীরের বাড়ি গাড়ি টাকা স্ট্যাটাস পদ কিছুই নেই। শেখ আকরাম আলী একজন এমএ (এলএলবি) আর আলমগীর মাত্র এইট পাস। একজন এইট পাস পিওনের কাছে একজন এমএ এলএলবির পরাজয় দেখে আমি অভিভূত। আলমগীরের সঙ্গে আমি আকরাম আলীকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলেছিলাম—বড়মাপের মানুষ তিনি। কিন্তু আজ এইট পাস আলমগীর প্রমাণ করে দিল উচ্চ পদে আসীন হলেই কেউ বড় মাপের মানুষ হয় না। অঢেল বিত্তবৈভব আর হ্যান্ডসাম স্যালারি শেখ আকরাম আলীর। কিন্তু লোকটার আত্মাই নেই। পিওন আলমগীর মাসে বেতন পায় সাকুল্যে নয়শো টাকা। এই টাকায় সে নিজে চলে এবং তার গরিব পরিবারকে চালায়। হতদরিদ্র এই ছেলেটি আমার কাছ থেকে টাকা না নিয়েই ক্ষুধার্ত আমার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছে! আলমগীরের মমতায়, ওর মানবিকতায় অভিভূত আমি ক্রমশ দ্রবীভূত হতে থাকি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
—পৃথিবীতে এ্যাতো এ্যাতো খাবার থাকতে তুই কিনা আমার জন্যে নিয়ে এলি কলা আর ডাব?
—ছার আপনের জন্ডিস। অইন্য খাবার খাতি পারবেন না। ভেজাল। কলা আর ডাবে ছার কুনু ভেজাল নাই।
—কতো খরচ করলি?
—আলমগীর অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা চুলকোয়। স্বভাবসুলভ কপট রাগে ধমকে উঠি আমি।
—বললি না হারামজাদা?
আমার এই হারামজাদা গালটার মধ্যে আলমগীর কোনো দোষ খুঁজে পায় না। আলমগীর জানে ওর মনোরমা ছার ওকে আদর করেই হারামজাদা বলে। কিন্তু আলমগীর জানে না যে ওর ছারের কাছে আসা সেই ‘স্যারদের স্যার’ পদস্থ আমলা শেখ আকরাম আলীই এই বিশেষণের প্রকৃত দাবিদার। আলমগীর জানে না—হতদরিদ্র এইট পাস আলমগীর আজ একজন এমএ, এলএলবিকে পরাভূত করেছে ওর অনায়াস মানবিক দক্ষতায়।
রচনাকাল/ অটোয়া ॥ ১০ জুলাই, ২০০৫
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের
ছাত্র ছিলাম আমিও!
ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী--০৫
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম আমিও!
লুৎফর রহমান রিটন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম একদা, এটা আমার একই সঙ্গে গৌরব আর বেদনার স্মৃতি। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতেই নির্বাচিত হয়েছিলাম নিয়মিত ছাত্র হিশেবে। আমার প্রাপ্ত নম্বর এমন কিছু বেশি না হলেও কলা ভবনের দেয়ালে (নাকি রেজিস্ট্রি বিল্ডিং?)মেধা তালিকায় নামটি সাঁটানোর পর্যায়েরই ছিলো। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর আবেগে থরোথরো ভর্তিচ্ছু একদঙ্গল ছেলেমেয়ের ভিড় ঠেলে নিজের নামটি আবিস্কার বা অবলোকন করে অপেক্ষায় ছিলাম ভাইবার জন্যে।
নির্দিষ্ট তারিখে কলা ভবনের একটি বিশেষ কক্ষে সময় মতো হাজির হলাম। সিরিয়াল অনুসারে আমার নামটি ডাকা হলো। আমি ভেতরে প্রবেশ করে উপস্থিত শিক্ষকদের সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার আবেদনপত্র এবং মার্কশিটে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাইবা বোর্ডের প্রধান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-- তোমার রেজাল্ট অনুসারে তুমি তো সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস কিংবা অন্য কোনো সাব্জেক্ট বেছে নিতে পারতে। তা না করে তুমি বাংলায় ভর্তি হতে চাইছো কেনো? বাংলা তো কেউ ইচ্ছে করে পড়তে চায় না। অন্য সাব্জেক্টে নম্বরে কুলোয় না বলে বাধ্য হয়েই বাংলা পড়ে। কিন্তু তুমি তো দেখছি একটি মাত্র সাব্জেক্টেই টিক চিহ্ন দিয়েছো! ঘটনা কী?
প্রবীন সেই শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে আমি বলেছিলাম—আমি তো স্যার লেখক হবো তাই বাংলাটাই পড়তে চাই।
আমার কথায় বোর্ডের সদস্য শিক্ষকেরা খানিকটা বিস্মিত হয়ে সম্মিলিত ভাবে আমার দিকে তাকালেন। আর প্রবীন সেই শিক্ষক একটা হাত তুলে আমাকে তাঁর কাছে যাবার ইঙ্গিত করে বললেন—আসো বাবা আসো তোমাকে দোয়া করে দেই। সাধারণত ছেলেমেয়েদের জোর করে আমরা বাংলায় পাঠাই আর তুমি হচ্ছো ব্যতিক্রমী সেই ছাত্র যে যোগ্যতা থাকা সত্বেও নিজের ইচ্ছায় বাংলা পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আসো আসো আমার কাছে আসো।
হাসিমুখে আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম স্যারের কাছে। তিনি আমার মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে আমাকে আদর করে দিলেন। দোয়া করে দিলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হলাম।
কিন্তু ক্লাশে আমি নিয়মিত উপস্থিত থাকতাম না।
প্রথম শিক্ষক হিশেবে পেয়েছিলাম নরেন স্যারকে। অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। পড়াতেন অলঙ্কার শাস্ত্র। রূপতত্ত্ব ধ্বনিতত্ত্ব। উপমা উৎপ্রেক্ষা। প্রথম ক্লাশটা ছিলো সকাল আটটায়। সকালের স্নিগ্ধতার সঙ্গে হালকা রোদের মিষ্টি প্রলেপ ছিলো সেদিন। নরেন স্যার ক্লাশে ঢুকতেন একদম ঘড়ির কাটায় কাটায়। মুখভর্তি নাতিদীর্ঘ সুশোভন দাঁড়ি। ঢিলেঢালা শাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর খদ্দরের কটি পরে একটা হাত উঁচিয়ে যাত্রার বিবেকের মতো ক্লাশে ঢুকতেন তিনি নাটকীয় ভঙ্গিতে, টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের মতো। বিশুদ্ধ উচ্চারণে শৈল্পিক কণ্ঠে তাঁর ধ্বনিত হতো কোনো কবিতার পঙ্ক্তি কিংবা নাটকের কোনো সংলাপ। প্রথম দিন ক্লাশে ঢোকার সময় তাঁর কণ্ঠে ছিলো চর্যাপদের পঙ্ক্তি--উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী/ মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী/ উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি/ ণিঅ ঘরণী ণামে সহজ সুন্দারী/ ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী /একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী...
অতঃপর ব্যাখ্যা দিলেন--উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে, তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা...
অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস প্রথম দর্শন আর আলাপেই আপন করে নিয়েছিলেন আমাকে। তরুণ লেখক হিশেবে আলাদা একটা সম্মান তিনি আমাকে দিতেন।
আমার করা দ্বিতীয় ক্লাশটি ছিলো অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফরের। ছাত্রছাত্রীরা আড়ালে তাঁকে বলতো 'কালা জাফর'। তিনি পড়াতেন 'কালকেতু উপাখ্যান'। প্রথম দু'দিন আমি অনুপস্থিত ছিলাম। তাই জানা ছিলো না তাঁর শিক্ষা পদ্ধতি। তিনি হাজিরা খাতা খুলে রোল কল করলেন। নরেন স্যার কে এটা করতে দেখিনি। আমাকে হতবাক করে জাফর স্যার অতঃপর একেকজন ছাত্রকে দাঁড় করিয়ে শব্দার্থ ধরা শুরু করলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে রীতিমতো অপমানজনক মনে হলো। পড়তে এসেছি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে। যথেষ্ঠ পড়াশুনা করেই। কিন্তু প্রাইমারী কিংবা হাইস্কুলের মাস্টারদের মতোই দেখলাম স্যারের আচরণ! 'কালকেতু উপাখ্যান পড়তে এই স্যারকে আমার দরকার নেই' সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিতীয়বার আর স্যারের ক্লাশে যাওয়া হলো না। জাফর স্যারের একটামাত্র ক্লাশ করার পর ক্লাশে যাবার আগ্রহই আমি হারিয়ে ফেললাম সত্যি সত্যি। বিখ্যাত অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেনের ক্লাশেও তাই গেলাম না আর। (ক্লাশ না করলেও আকরম স্যার আমার চলার পথকে কণ্টকিত করতে উদ্যোগী হননি এক মুহূর্তের জন্যেও।) বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই ঠিকই কিন্তু ক্লাশ না করে লাইব্রেরীতে এবই সেবই পড়ে কিংবা টিএসসি বা হাকিম চত্বরের ঘাসে বসে আড্ডা দিয়েই বিকেল গড়ায়। হাকিম চত্বরের ঘাসে রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, আহমদ আজিজ, তুষার দাশ, ইসহাক খানদের সঙ্গে ধোঁয়াচ্ছন্ন আড্ডা-কোলাহলে দুপুরের কড়া রোদ ফিকে হয়ে আসে। ক্লাশমেটদের চাইতে খানিক সিনিয়র এই গ্রুপের সঙ্গে আড্ডাতেই আগ্রহ ছিলো আমার। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার আগে থেকেই এঁদের সঙ্গে আমার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো।
খানিক আগেই বলেছি যে ক্লাশ না করলেও আকরম স্যার আমার চলার পথকে কণ্টকিত করতে উদ্যোগী হননি এক মুহূর্তের জন্যেও। হ্যাঁ, একটি ক্লাশও করিনি আমি আকরম স্যারের। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার আগে একটা ফরম্যাট মুদ্রিত কাগজে শিক্ষকদের সিগনেচার সংগ্রহ করা লাগতো। সেই সাক্ষরই সাক্ষ্য দেবে যে এই ছাত্রটি তাঁরই ছাত্র এবং ছাত্রটিকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া যায়। এই সাক্ষরের অর্থ শিক্ষার্থীর টিউটোরিয়াল স্বল্পতা নেই। নরেন স্যার সই করে দিয়েছেন। আমার লাগবে আকরম স্যারের সই। প্রখ্যাত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আকরম স্যারের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাঁর নেমপ্লেটটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক পর্যায়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলাম--আসতে পারি স্যার? নায়কোচিত চেহারা পরিপাটি চুল আর পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবি পরা আকরম স্যার বসেছিলেন তাঁর আসনে। কালো মোটা ফ্রেমের চশমার কাচের ভেতর দিয়ে তাঁর দ্যুতিময় চোখের ব্যক্তিত্বপূর্ণ উদ্ভাস আমাকে মুগ্ধ করলো। আমি কাগজটি তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলাম--একটা সিগনেচার স্যার...।
কাগজটায় চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর তিনি বিস্ময়মিশ্রিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন--তুমি আমার ছাত্র!!
তাঁর চোখে চোখ রেখেই খানিকটা লজ্জা মেশানো হাসিতে অপরাধীর ভঙ্গিতে বললাম--জ্বি স্যার।
'কিন্তু তোমাকে কোনোদিন আমি ক্লাশে দেখিনি' বলতে বলতে সাক্ষর করে কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
পরবর্তীতে এই আকরম স্যারের সঙ্গেই স্থাপিত হয়েছে আমার ছাত্র-শিক্ষকের চিরকালের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর স্নেহের সম্পর্কটি।
২০০০ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম স্মৃতিগদ্যের বই 'যত্রতত্র কয়েকছত্র' আমি উৎসর্গ করেছি আমার প্রিয় এই স্যারকেই। উৎসর্গপত্রে আমি নিজেকে তাঁর জীবনের সেরা ফাঁকিবাজ ছাত্র হিশেবে একদিনও তাঁর ক্লাশে উপস্থিত না থাকার কথাটিও উল্লেখ করেছিলাম। প্রচণ্ড মেধাবী এবং অবিশ্বাস্য রকমের সৎ এই মানুষটি বাড়তি টাকা উপার্জনের জন্যে খাতা দেখার ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করেননি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সমাপ্তি ঘটার পর এক পর্যায়ে তিনি আমাকে তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্রের আসনটিও অনায়াসে দান করেছিলেন।
সদস্যদের ভোটে আমি বাংলা একাডেমির কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলাম। কার্যনির্বাহী পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের একটা অধিকার থাকে দু'জন বিশিষ্টজনকে কোঅপ্ট করার। আমরা সৈয়দ আকরম হোসেন এবং রিজিয়া রহমানকে কোঅপ্ট করেছিলাম। বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদে তাঁর সঙ্গে দু'বছর কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কতোটা সৎ প্রাজ্ঞ আপসহীন ও পরিচ্ছন্ন রুচির আধুনিক মানুষ তিনি।
আমি যে তাঁর ছাত্র সেটা তিনি কখনোই ভুলে যেতেন না। মিটিং শেষে বাংলা একাডেমি থেকে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারের বাড়িতে যাবার সময় আমাকে প্রায়শঃ সঙ্গী করতেন তিনি।(আমার স্যার একা একা বাড়ি ফিরবেন এটা আসলে আমিও চাইতাম না।) মজার ব্যাপার হচ্ছে, টিএসসি এলাকায় রাস্তা পেরুনোর সময় তিনি আমার হাত মুঠোবন্দি করতেন। তারপর আমাকে হাত ধরে নিরাপদে রাস্তা পার করিয়ে দিতেন। আমি যেনো তাঁর ছাত্র নই, পুত্র! আমি যেনো তাঁর ভাই। পুত্রের প্রতি পিতার মমতা কিংবা অনুজের প্রতি অগ্রজের মমতা আমি বহুবার প্রত্যক্ষ্য করেছি অনুভব করেছি আকরম স্যারের কথায় আচরণে এবং কর্মকাণ্ডে।
এখনও, প্রতিবছর বাংলাদেশে গিয়ে কানাডা ফেরার দিন উত্তরায় স্যারের বাড়িতে স্যারের সঙ্গে কয়েক ঘন্টা সময় কাটিয়ে স্যারের সান্নিধ্যের মধুমাখা স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে তবেই আমি বিমানে উঠি। আমি ডালপুরি পছন্দ করি বলে আকরম স্যার আমার জন্যে পর্যাপ্ত ডালপুরির যোগান রাখেন। স্যারের স্ত্রী আমাদের প্রিয় ভাবীটিও অসাধারণ মায়াবতী একজন। আমাকে তিনিও সন্তানের মতো ছোটভাইয়ের মতো স্নেহরসে সিক্ত করেন।
ফিরে আসি বাংলা বিভাগের শ্রেণিকক্ষে।
দিন যায়।
মাস যায়।
প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা দিচ্ছি। ডিউটি দিচ্ছেন জাফর স্যার। তিনি পরীক্ষা কক্ষে চেয়ারে না বসে টেবিলে আরাম করে পা ঝুলিয়ে বসে বসে দায়িত্ব পালনের এক পর্যায়ে হঠাৎ আমাকে লক্ষ্য করে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন—এই তুমি রিটন না? আমি বললাম—জ্বি স্যার।
--তুমি আমার ছাত্র?
--জ্বি স্যার।
--কিন্তু ক্লাশে তো আসো নাই নিয়মিত। তোমাকে তো আমি পরীক্ষা দিতে দেবো না। কলম বন্ধ করো।
আমি লেখা থামিয়ে দিলাম। কলমটা বন্ধ করলাম। স্যার হুঙ্কার ছাড়লেন—একদম লিখবে না। খাতা বন্ধ।
আমি বললাম—লিখছি না স্যার।
আমার আশপাশের ছেলেমেয়েরা আমার ভবিষ্যৎ ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। দু'একজন ফিঁসফিঁসিয়ে বললেন--মাফ চেয়ে ন্যান মাফ চেয়ে ন্যান।
আমি বললাম—আরে নাহ্ মাফ-টাফ চাইবো না আমি। পরীক্ষাই তো দিতে দেবে না। না দিক। এর বেশি আর কিছু করার নেই তাঁর। পরীক্ষা দেবো না আমি।
স্যার টেবিল থেকে নামলেন খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে--পরীক্ষা দেয়া এতো সহজ না। আমি তোমাকে পরীক্ষা দিতে দেবো না। তুমি বেরিয়ে যাবে। দাও খাতা ফেরত দাও আমাকে। বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে বীর দর্পে পা বাড়ালেন তিনি।
পরীক্ষা হলে কিছুটা বিব্রতকর কিছুটা আতঙ্কজনক একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। হলের সমস্ত ছেলেমেয়ে লেখা বন্ধ করে একবার আমার দিকে একবার স্যারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। আমি খুব ঠান্ডা মাথায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর কলমটা বুক পকেটেই গেঁথে বেঞ্চির ওপরেই খাতাটা ফেলে রেখে নির্লিপ্ত পদক্ষেপে স্যারকে পাশ কাটিয়ে হল থেকে বেরিয়ে এলাম। কয়েক মিনিটের রীতিমতো একটা যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হলো পরীক্ষা হলে। স্নায়ুযুদ্ধ। রক্তপাতহীন। যুদ্ধে জয়লাভ করলেন জাফর স্যার।
এই ঘটনা নরেন স্যারের কানে গেলো। হাকিম চত্বরের সামনে আমাকে পাকড়াও করলেন নরেন স্যার—আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি তোমার ঘটনা শুনে। জাফর এটা না করলেও পারতেন। আমরা কি তোমাকে আটকে রাখতে পারবো? আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তোমাদের পার করে দেয়া। রুদ্রও আমার ছাত্র ছিলো। একদিন পরীক্ষার দিন, সকালে আমি এই এখান দিয়েই পরীক্ষা হলের দিকে যাবার সময় দেখলাম, মাঠে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা পেটাচ্ছে রুদ্র। আমি গিয়ে বলেছিলাম—তোমার তো পরীক্ষার হলে থাকার অথা। এইখানে কী করছো? রুদ্র বলেছিলো--আমি স্যার পরীক্ষা দেবো না।
জানতে চাইলাম, কেনো দেবে না?
রুদ্র বললো, প্রস্তুতি নিইনি স্যার।
আমি বললাম, প্রস্তুতি লাগবে না তোমার। পরীক্ষা দিলেই পাশ করবে তুমি। চলো তো। ওঠো। তারপর ওর হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম পরীক্ষার হলে। এবং রুদ্র পাশ করেছিলো। আমরা কি তোমাদের আটকে রাখতে পারবো? তোমরা ঠিকই বেরিয়ে যাবে। বড় কবি হবে। তাতে আমাদেরই তো গৌরব। কী দরকার পথকে রুদ্ধ করবার। মসৃণ করতে না পারি আটকে দিতে তো পারি না...। দেখি জাফরকে বলবো আমি।
স্যারের কথায় আমার চোখে জল চলে এলো। বললাম—না স্যার। দরকার নেই।
নরেন স্যারকে খুব মনে পড়ছিলো আজ। একটু আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি কার্ডটা হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার পর এক ঝটকায় ঘটনাগুলো দৌঁড়ে এলো চোখের সামনে। এটাচড্ ছিলাম মোহসিন হলের সঙ্গে। প্রভোস্ট হিশেবে বিখ্যাত আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যারের সাক্ষর রয়েছে লাইব্রেরি কার্ডে, আমার ছবির ওপর। আহারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আহারে বাংলা বিভাগ।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ইমদাদুল হক মিলন > তারুণ্য স্পর্ধিত স্মার্ট লেখকের প্রতিচ্ছবি
ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী--০৩
ইমদাদুল হক মিলন > তারুণ্য স্পর্ধিত স্মার্ট লেখকের প্রতিচ্ছবি
লুৎফর রহমান রিটন
লেখক ইমদাদুল হক মিলনের যাত্রা শুরু শিশুসাহিত্যের হাত ধরে। 'বন্ধু' নামের একটি ছোটদের উপযোগী গল্প দিয়েই আজকের মহাবিখ্যাত কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের দীর্ঘ অভিযাত্রার সূচনা ঘটেছিলো। তাঁর হাতে ছিলো একটি সোনার কলম। সেই সোনার কলম দিয়ে এরপর অবিরাম লিখে গেছেন মিলন। চেহারা পোশাক আর চালচলনের মতোই তাঁর স্মার্ট গদ্যভঙ্গিটি শিগগিরই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তরুণ বয়েসে সেই যে জনপ্রিয় হয়েছেন, আজও সেই জনপ্রিয়তাকে ধরে রেখেছেন তিনি। তাঁর বেশিরভাগ লেখাই বড়দের উপযোগী। কিন্তু শিশুসাহিত্য দিয়ে যাঁর লেখালেখির সূচনা, ছোটদের তিনি উপেক্ষা করবেন কী ভাবে! না, ছোটদের তিনি মোটেও উপেক্ষা করেননি। ছোটদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি একের পর এক বই লিখেছেন তাদের জন্যে। সেই তালিকাটা মোটেও ছোট নয়। চিতারহস্য, রাত বারোটা, ভূতের নাম রমাকান্ত কামার, ভূতগুলো খুব দুষ্টু ছিলো, ভূতের নাম হাবা গঙ্গারাম কিংবা ডাকাতরাও মানুষ—এরকম বেশ কিছু বইয়ের নাম স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারি। 'ডাকাতরাও মানুষ' উপন্যাসটি আমার সম্পাদিত 'ছোটদের কাগজ'-এ ছাপা হয়েছিলো ১৯৯৭ সালে।
ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে আমার অনেক মিল খুঁজে পাই আমি। প্রায় একই সময়ে লেখালেখির শুরু আমাদের। আমার প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিলো ১৯৭২ সালে, দৈনিক ইত্তেফাকের ছোটদের পাতা কচি-কাঁচার আসরে। ছেপেছিলেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। ইমদাদুল হক মিলনের প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিলো ১৯৭৩ সালে, দৈনিক পূর্বেদেশের ছোটদের পাতা চাঁদের হাটে। ছেপেছিলেন রফিকুল হক দাদুভাই। আমাদের নামের ব্যাপারেও মিল রয়েছে। আমরা দু'জনেই নামের সঙ্গে ডাকনাম ব্যবহার করি।
২
মূল নামের সঙ্গে ডাক নাম বা নিক নেম থাকলে আফলাতুন ভাই সেই লেখকের কোনো লেখা ছাপতেন না। দৈনিক বাংলা পত্রিকাটির ছোটদের পাতা 'সাতভাই চম্পা'র সম্পাদক ছিলেন আফলাতুন নামের এক সাংবাদিক সাহিত্যিক। সত্তরের দশকে 'সাতভাই চম্পা' এবং আফলাতুনের সঙ্গে আমার বিপুল সখ্য গড়ে ওঠে। আফলাতুন ভাই আমার একটি ছড়া তাঁর সম্পাদিত পাতায় ছাপলেন শুধু লুৎফর রহমান নামে। নামের রিটন অংশটাকে বলপেনের লাল কালিতে ঘ্যাচাং করে দিলেন পরম তৃপ্তি আর চরম নিষ্ঠুরতায়। ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসর, এবং সংবাদের খেলাঘরসহ দেশের বিভিন্ন দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিক পত্রিকায় তখন আমি ধুমসে লিখে যাচ্ছি। আর কোনো সম্পাদক আপত্তি করেন নি রিটন নিয়ে। একমাত্র সম্পাদক আফলাতুন--যিনি লেখকের নামের সঙ্গে ডাক নাম ছাপবেন না বলে কঠিন এবং অবাস্তব একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকলেন তাঁর দফতরে। নামের সঙ্গে ডাকনামটি যুক্ত আছে বলে তখনকার উঠতি তরুণ লেখক ইমদাদুল হক মিলনের কোনো লেখাও তিনি ছাপতেন না। আফলাতুন ভাইয়ের নিষ্ঠুরতার বলি 'রিটন'কে অতঃপর আমি পুনর্জন্ম দিয়েছিলাম 'রিটন রহমান' নামে। এই নামে আমার প্রচুর লেখা ছাপা হয়েছিলো তখন দৈনিক বাংলার সাতভাই চম্পায়।
আমি যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়টায় ছোটদের সেরা পাতা ছিলো সাতভাই চম্পা। মেক আপ গেট আপের দিক থেকে ওই পাতার ধারে কাছেও ছিলো না আর কোনো পাতা। ব্রডশিটের দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হতো সাত ভাই চম্পা। শাদাকালোয় ওরকম ঝকমকে আধুনিক রুচিস্নিগ্ধ পাতা আর দ্বিতীয়টি ছিলো না। রিটন রহমান নামে আবির্ভূত হবার আগে আফলাতুন ভাইয়ের সঙ্গে প্রচুর তর্ক করেছি। আমাদের কথা কাটাকাটি বা ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি তখনকার তরুণ কিন্তু খ্যাতি অর্জন করা লেখক ইমদাদুল হক মিলনের প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম। আফলাতুন ভাই বীরদর্পে বলেছিলেন--'যতদিন পর্যন্ত সে তার ডাকনামটি ছেঁটে না ফেলবে ততদিন আমি তার লেখা ছাপব না। ডাক নাম ব্যবহার করে গাড়লরা।'
এই ঘটনার অনেক বছর পর ঢাকা প্রেসক্লাবে চায়ের টেবিলে মুখোমুখি বসে আমি আর আফলাতুন ভাই গল্প করছিলাম। সাতভাই চম্পার তখন করুণ অবস্থা। দৈনিক বাংলা কর্তৃপক্ষ দুই পৃষ্ঠা থেকে এক পৃষ্ঠা এবং এক পৃষ্ঠা থেকে অর্ধ পৃষ্ঠা জায়গা বরাদ্দ দিচ্ছে তখন সাতভাই চম্পাকে। যে কোনো দিন বন্ধ হয়ে যাবে এককালে ছোটদের বিখ্যাত পাতাটি। আফলাতুন ভাই দুঃখ করে সেই কাহিনিই বলছিলেন আমাকে।
খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আফলাতুন ভাইকে আমি বলেছিলাম--আপনার দীর্ঘ জীবনে সম্পাদক হিশেবে আপনার ব্যর্থতা কি জানেন আফলাতুন ভাই?
--কী?
--আপনি আপনার সম্পাদকজীবনে দু'জন পাঠকপ্রিয় লেখকের একটি লেখাও ছাপেননি বা ছাপাতে পারেননি।
--কোন দু'জনের কথা বলছো?
--ইমদাদুল হক মিলন আর লুৎফর রহমান রিটন।
--কী বলছো এসব? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মিলনের কোনো লেখা আমি ছাপিনি সত্যি কিন্তু তোমার তো অসংখ্য লেখা ছেপেছি আমি সাতভাই চম্পায়, প্রায় প্রতি সপ্তাহে!
--হ্যাঁ আপনি রিটন রহমানের লেখা ছেপেছেন নিয়মিত কিন্তু লুৎফর রহমান রিটনের একটিও নয়।
--কী আবোল তাবোল বকছো? তুমি কি রিটন রহমান নও!
--না। আমি রিটন রহমান নই। আমি লুৎফর রহমান রিটন। সতেরটি বই বেরিয়েছে (তখনকার হিশেব অনুযায়ী) লুৎফর রহমান রিটনের, অথচ সমসাময়িককালের একজন তুখোড় সম্পাদক হওয়া সত্বেও লুৎফর রহমান রিটনের একটি লেখাও আপনি ছাপেননি ডাক নামের কারণে।
--হ্যাঁ, ডাক নামের কারণে। ডাক নাম আমি ছাপি না।
--তাতে সেই লেখকের কিছুই আসে যায় না। আপনি আমার লেখা ছাপেননি। আপনি মিলনের লেখাও ছাপেননি। অথচ চল্লিশটা বই বেরিয়ে গেছে তাঁর। মিলন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। এবং মিলন প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন নামেই। আপনি আপনার জীবদ্দশাতেই দেখতে পাচ্ছেন ডাকনামটা সঙ্গে রেখেই মিলন-রিটনরা মর্যাদা পাচ্ছে। লেখক হিশেবে মিলনের সমান প্রতিষ্ঠা আপনি পাননি, এমনকি আপনার নামটি খুবই ব্যতিক্রমী 'আফলাতুন' হওয়া সত্বেও।
আমার কথার কোনো জবাব দিতে পারেননি আফলাতুন ভাই। বিপন্ন ও বিষণ্ণ মানুষটাকে দেখে সেদিন আমার খুবই মায়া হচ্ছিলো। ভেতরে ভেতরে খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম আমিও, অনেকগুলো অপ্রিয় ও কড়া কথা তাঁকে শুনিয়ে ফেলেছি বলে। কারণ আমার লেখালেখির জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হিশেবে আমি মূল্যায়ন করি এই প্রাজ্ঞ এবং ধীমান ব্যক্তিত্ব আফলাতুনকেই।
বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে অবশেষে আফলাতুন ভাই খুবই বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেছিলেন--মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক। তোমার যুক্তিটা মেনে নিলাম। মিলনকে তো এই মুহূর্তে পাচ্ছি না আমি। তুমি বরং এক কাজ করো। আগামীকাল দুপুরের মধ্যে একটা ছড়া নিয়ে আসো তো দৈনিক বাংলায়। পাতাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটাই শেষ সংখ্যা কী না জানি না। অন্তত একটা লেখা ছাপা হোক তোমার, আমার সম্পাদিত পাতায়, এবং তোমার নিজের নামে।
হ্যাঁ, দু'দিন পরেই সাতভাই চম্পায় ছাপা হয়েছিলো আমার ছড়াটি। এবং সেটা লুৎফর রহমান রিটন নামেই। সম্ভবতঃ সাতভাই চম্পার ওটাই ছিলো আফলাতুনের সম্পাদনায় প্রকাশিত সর্বশেষ সংখ্যা। ডাকনামসহ ইমদাদুল হক মিলনের একটি লেখাও ছাপতে আগ্রহী ছিলেন আফলাতুন ভাই। এই ঘটনাটি ইমদাদুল হক মিলনকে বলা হয়নি। বলা উচিৎ ছিলো আমার। বললে আফলাতুন ভাইয়ের ব্যাপারে মিলনের অভিমান বা ক্ষোভটুকুর হয়তো অবসান ঘটতো। আমি জানি আফলাতুন ভাইয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ বা ক্ষোভ ছিলো ইমদাদুল হক মিলনের। একটি রচনায় তিনি আফলাতুন ভাইয়ের নাম নিয়ে কঠিন বিদ্রুপ করেছিলেন পুরনো ঢাকার বিখ্যাত মিষ্টি 'আফলাতুন'-এর সঙ্গে মিলিয়ে--একটা হালুয়া টাইপের মিষ্টির নামে একজন মানুষের নাম হয় কী করে!
৩
আমার সঙ্গে ইমদাদুল হক মিলনের বয়েসের ব্যবধান পাঁচ/ছয় বছরের। এই অল্প পার্থক্য সত্বেও মিলন আমার মহা অগ্রজের আসনে অধিষ্ঠিত। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাঁকে আমি আপনি সম্বোধন করি। তিনি আমাকে সম্বোধন করেন তুমি। এই তুমি আপনির ব্যাপারটি আসলে খুবই খুচরো। কারণ আমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসি। শ্রদ্ধা করি পরস্পরের মেধাকে। লেখালেখির মাধ্যমটি ভিন্ন হলেও আমাদের দু'জনের মিল রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। মিল সম্ভবত আমাদের চেহারাতেও। মিল আমাদের পোশাক আশাকে। চাল চলনেও। আমাদের চেহারাসুরৎ মোটেও লেখকসুলভ নয়। কেমন গুণ্ডা গুণ্ডা লাগে।
অনেক বছর আগে, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা চারটি ঝলমলে তরুণী একবার বাংলা একাডেমীর বইমেলায় উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আমাকে বলেছিলো--'আপনি আমাদের ভীষণ প্রিয়। আপনার 'দুঃখ-কষ্ট' আমাদের খুব ভালো লেগেছে। অটোগ্রাফ প্লিজ।' ওই চারজন আমাকে মিলন ঠাউরেছে বুঝতে পেরেও নিরুত্তর আমি হাসিমুখে অটোগ্রাফ দিয়েছি ওদের ডায়রিতে। স্বাক্ষরের জায়গায় ইমদাদুল হক মিলনের নামটি না লিখে যখন লুৎফর রহমান রিটন লেখা হলো তখন লজ্জা মেশানো হাসিতে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলো ওরা--'য়ে মা, আপনাদের দু'জনার চেহারায় এত্তো মিল!'
একবার দু'বার এমনটি ঘটেছিলো মিলনের বেলাতেও। মিলনই আমাকে বলেছিলেন—এক সন্ধ্যায় রোকেয়া হলের কিংবা শামসুন্নাহার হলের মিলনায়তনে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মিলনকে ঢুকতে দেখে উপস্থাপক মেয়েটা নাকি ঘোষণা করেছিলো আমার নামটি!
এরপর দিন গড়িয়েছে।
মিলনের কপাল সম্প্রসারিত হয়েছে। মাথায় মৃদু টাকের আবির্ভাব ঘটেছে। তাছাড়া তাঁর ঠোঁট থেকে গুম্ফজোড়া উধাও হওয়াতেও বেঁচে গেছি আমি। এক পর্যায়ে আমার লম্বা চুলও খাটো হয়েছে। মাথায় টাকের আগমনীবার্তা অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।(কিন্তু আমার হালুম মার্কা গুম্ফজোড়া টিকে আছে!) আমাদের দু'জনার চেহারার সাদৃশ্য বা সামঞ্জস্য আর নেই। কেউ আর আমাকে মিলন ভেবে আমার কাছে অটোগ্রাফ চাইতে আসে না এখন!
৪
এই লেখাতেই বলেছি আমরা পস্পপর পরস্পরকে ভালোবাসি। একটা নমুনা দিই।
'টেলিভিশন' নামের একটা মাসিক পত্রিকা ছিলো। ১৯৯৩-এর সেপ্টেম্বরে ওরা একটি অভিনব নিলামের আয়োজন করেছিলো। নিলামের আইটেম হিশেবে ওরা হাজির করেছিলো 'তারকাদের ব্যবহার করা বস্তু-সামগ্রী'। তারকাদের মধ্যে অভিনয়শিল্পী ও নাট্যকাররাও ছিলেন। শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত চত্বরের সেই অনুষ্ঠানে শেষ বিকেলে হাজির হয়েছি যখন তখন নিলামে তোলা হয়েছে লেখক-টিভি নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলনের একটি কলমকে। ঘোষক জানাচ্ছিলেন—এই কলম দিয়েই মিলন লিখেছেন তাঁর পাঠকপ্রিয় উপন্যাস 'ভালোবাসার সুখদুঃখ'। দেখলাম খুবই অল্প দামে উদ্যোক্তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন ইমদাদুল হক মিলনের কলমটি। এতো অল্প দাম যে সেটা রীতিমতো অসম্মানজনক। দামটা উল্লেখ করে ঘোষক 'এক লক্ষ এক, এক লক্ষ দুই, এক লক্ষ তিন টাইপের একটা অতিক্ষুদ্র সংখ্যা ঘোষণা করছিলেন। তিনি তিন উচ্চারণ করার আগে কেউ দাম না বাড়ালে বস্তুটি সেই ক্রেতার মালিকানায় চলে যাবে। ঘোষক দুই গোণার পরেই সহসা ভিড়ের মধ্য থেকে হাত তুলে আমি কলমটির দাম খানিকটা চড়িয়ে দিলাম। যে ভদ্রলোক কলমটির মালিক হতে যাচ্ছিলেন তিনি খানিকটা হতভম্ব। কারণ লেখক বা নাট্যকারের কলম কিনতে আগ্রহী লোকের সংখ্যা অতি নগন্যই ছিলো সেই নিলাম অনুষ্ঠানে। আমার দাম বাড়ানোর কারণে সেই ভদ্রলোক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও সেটা সামলে নিয়ে তিনি আরো দশ টাকা বাড়ালেন। আমি বাড়ালাম পঞ্চাশ টাকা। তিনি আরো দশ বাড়ালেন। আমি বাড়ালাম একশো টাকা। আমার মাথায় কী যে চাপলো তখন! আমি ওখানে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম--এরপরও কেউ যদি আর দশ টাকা বাড়ায় তো আমি বাড়াবো পাঁচশো। এবং এভাবে বাড়াতেই থাকবো। এক পর্যায়ে উৎসাহী জনতাকে(!) পরাজিত করে আমিই বিজয়ী হলাম। ঘোষক মহা আনন্দে আমার বলা দামটি তিনবার উচ্চারণ করলেন। সে কী বিপুল করতালি উপস্থিত দর্শকদের!
সেই অনুষ্ঠানটির বিশেষ বিশেষ অংশ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিক শামীম আলম দীপেন। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো--কেনো আমি মিলনের কলমটি অপেক্ষাকৃত বেশি দামে কিনে নিয়েছি। আমি তখন বলেছিলাম--ইমদাদুল হক মিলনের মতো একজন লেখকের কলমের দাম এতো কম কম হবে কেনো? এটা তো সেই লেখকের প্রতি রীতিমতো অসম্মান। আমি লেখক ইকদাদুল হক মিলনকে সম্মান জানাতেই কলমটি সামান্য বেশি দামে কিনে নিয়েছি। যদিও এই কলম দিয়ে আমি লিখবো না কিছুই। এটা লেখক মিলন ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা।
দীপেনকে সাক্ষাৎকার দেবার পরে সেই ভদ্রলোককে অনেক খুঁজেছি আমি। আমার ইচ্ছে ছিলো কলমটি আমি তাঁকে উপহার দেবো। টাকার অংকে তিনি আমার সঙ্গে সেই সময়টায় পেরে ওঠেননি কিন্তু তিনিও যে মিলনকে ভালোবাসেন সেটা তো প্রমাণিত কারণ তিনি ছাড়া আর কেউ তো কোনো দাম হাঁকায়নি! কিন্তু সেই ভদ্রলোককে পাইনি বলে মিলনের কলমটি তাঁকে উপহার দেয়া হলো না।
আসাদুজ্জামান রিপন সম্পাদিত সেই টেলিভিশন পত্রিকাটির অক্টোবর সংখ্যায় পাঠকের চিঠি বিভাগে একটি চিঠি ছাপা হয়েছিলো। অনুজপ্রতীম এক চলচ্চিত্র সাংবাদিক সেই সংখ্যাটা আমার জন্যে নিয়ে এসেছিলেন। 'মিলনের কলম' শিরোনামে চিঠিটা ছিলো এমন--'টেলিভিশন পত্রিকাকে ধন্যবাদ যে, তারা তারকাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদির অভিনব একটি নিলামের আয়োজন করেছেন। আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে সারাদিন ধরে নিলামস্থলে ঘুরে বেরিয়েছি। আমার প্রিয় অনেক তারকাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। টেলিভিশন পত্রিকা এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য চিরকালই আমার প্রিয় পত্রিকা হয়ে থাকবে। তবে একটা ব্যাপারে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি তা হলো ইমদাদুল হক মিলনের কলম। গত ফেব্রুয়ারির বইমেলায় বেরিয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস 'ভালোবাসার সুখ দুঃখ'। উপন্যাসটি ইতোমধ্যেই তৈরি করেছে জনপ্রিয়তার এক নতুন রেকর্ড। যে কলমটি দিয়ে তিনি এই উপন্যাস লিখেছিলেন সেই কলমটিই নিলামে তুলেছিল টেলিভিশন পত্রিকা। কলমটি আমি কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমার চেয়ে অনেক বেশি দাম তুলে ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন তা কিনে নিয়েছেন। আমার পকেটে খুব বেশি টাকা ছিল না। থাকলে রিটন সাহেবের দ্বিগুণ দাম দিয়ে আমি ওই কলমটি কিনে নিতাম...নাজমুল আলম, মিরপুর ঢাকা।'
৫
ইমদাদুল হক মিলনও যে আমাকে ভালোবাসেন তার একটা নমুনাও দেয়া যাক এবার।
'আমাদের ময়না পাখিগুলো' নামে মিলনের একটি বই বেরিয়েছিলো ২০১০ সালে, সময় প্রকাশন থেকে। বইমেলায় সময়ের স্টল থেকে এক কপি বই তুলে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন মিলন ভাই। বলেছিলেন--উৎসর্গের পাতাটা দেখো। আমি দেখলাম উৎসর্গপত্রে মিলন লিখেছেন--'লুৎফর রহমান রিটন বাংলা ছড়াসাহিত্যের মহারাজ।'
আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই পাতায় তাঁর একটি অটোগ্রাফ নিয়ে নিলাম। এবং সেই কারণে বইটা অমূল্য হয়ে গেলো মুহূর্তেই! অতঃপর বইটা আমার সঙ্গে কানাডাও চলে এসেছে।
এই লেখাটি লিখতে লিখতে বুক সেলফ্ থেকে 'আমাদের ময়না পাখিগুলো'কে লেখার টেবিলে নিয়ে এলাম।
স্মৃতির এলবামে মিলন ভাইয়ের কতো কতো ছবি যে দীপ্তি ছড়াচ্ছে!
অটোয়া ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
